মঙ্গলবার, ৩ এপ্রিল, ২০১২

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সম্মাননা, কাকে?


বাংলাদেশের সংবাদপত্র পড়ি না। বন্ধুমুখে কিছু জরুরি খবর পাই তবে। গত বছর যেমন, স্বাধীনতার ৪০ বছর উপলক্ষে কয়েকজন বিদেশিকে সম্মানিত করা হবে, যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে, স্বাধীনতায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাহায্য করেছেন। জেনে সুখি, আনন্দিত।
জানি, বিএনপি সম্মাননা দেবে না। আওয়ামী লীগকেই দিতে হবে।
স্থির বিশ্বাস হয় আমার, সম্মানপ্রাপকের বিষয়ে আওয়ামী লীগ যথারীতি তত্ত্বতালাশ করে, কার কী অবদান সঠিক মূল্যায়ন করেছে। তো, এই নিয়ে মাথা খামচাইনে। আওয়ামী লীগের প্রতি আস্থাশীল।
২৭ মার্চ, রাত প্রায় ১০টা (বাংলাদেশে রাত ৩টা)। একজন নয়, ৩-৪ জন ফোন করেন মোবাইলে। অভিযোগ, বার্লিনে আপনার বাসায় ফোন করেছি বারকয়েক। ধরেননি।
বলি, ‘এখন প্যারিসে। ছুটি কাটাতে।’
ল্যান্ডলাইনের বদলে মোবাইলে ফোন যখন, নিশ্চয়ই জরুরি। প্রত্যেকের এক কথা, একটিই অনুরোধ, ইন্টারনেটে বাংলাদেশের নিউজপেপার দেখুন। আমাদের স্বাধীনতার সম্মাননা প্রাপকের নাম দেখুন। রামু (সুনীল) দাশগুপ্ত, তার স্ত্রী বারবারা দাশগুপ্তও প্রাপক?
একজন বললেন, রামায়নের যুগ নেই, ধরণী দ্বিধা হয় না আজকাল।
সুনীল দাশগুপ্ত, বারবারা দাশগুপ্ত সম্মাননা প্রাপকের তালিকায়? ঢাকায় গিয়ে সম্মান-পুরস্কারে ভূষিত?Ñ রীতিমতন বিস্ময় মানি। পুরস্কার তথা সম্মাননা প্রদানে নিশ্চয় গভীর ষড়যন্ত্র। ইন্টারনেট দেখি।

জানিয়ে রাখা দরকার, ইউরোপীয় সময়ে রাত ৯টার মধ্যেই বাংলাদেশের সমস্ত সংবাদপত্রের ইন্টারনেট সংস্করণ (পরদিনের সংবাদপত্র) প্রকাশিত। দেখলুম তালিকা। কয়েকটি নাম অবিশ্বাস্য। কী করে প্রাপক ওঁরা? কী অবদান ওঁদের মুক্তিযুদ্ধে, স্বাধীনতায়?

বিস্তারিত না হোক, মাত্র কয়েক লাইন, সংক্ষেপে বাংলাদেশ সরকার কি ওঁদের অবদান সম্পর্কে জানাবেন? মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে সুনীল-বারবারা দাশগুপ্তের কী অবদান? চাপাবাজি নয়, প্রত্যক্ষ প্রমাণ চাই। নথিপত্র চাই।

সুনীল-বারবারা দাশগুপ্ত তৎকালীণ কমিউনিস্ট পূর্ব বার্লিনের বাসিন্দা। বসবাস দীর্ঘদিন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কার কী ভূমিকা, কে কী করেছেন, স্ট্যাসির (গোপন পুলিশ সংস্থা) কাছে সব আছে। লিখিত। ফাইলবন্দি। কোনো নথিপত্র ধ্বংস করা হয়নি।

আমরা জানি, পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য প্রায়-প্রত্যেক নাগরিকই। অধিকাংশই ছুটকো সদস্য। এঁদের পাত্তা দেয় না পলিটব্যুরো। পাত্তা পাওয়ার যোগ্যতা নেই। রামু-বারবারাও লাপাত্তা সদস্য। হাইকমান্ডের নির্দেশ ছাড়া রামু-বারবারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কবে, কখন, কীভাবে সাহায্য করেছেন? স্ট্যাসির ফাইল ঘেঁটে কি প্রমাণ দিতে পারবেন? না। তাহলে কেন সম্মাননা প্রদান করা হলো তাকে?

রহস্য আছে অবশ্যই। স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ থেকে ফালতুমার্কা কমিউনিস্টরা পূর্ব বার্লিনে এসে রামু-বারবারা আস্তানায় আশ্রয় নিয়েছেন। থেকেছেন। হোটেলের পয়সা বাঁচিয়েছেন। চা-কফি-রুটি-ডিমভাজি খেয়েছেন। ডিমভাজিতে নুন থাকে। তো, নুন খেয়ে কী করে নিমকহারামি করবেন? স্বাধীনতার সম্মাননা প্রাপকের লিস্ট যারা তৈরি করেছেন, মস্কোপন্থি ফালতু কমিউনিস্টরাও যুক্ত। বাংলাদেশের এই ফালতু কমিউনিস্টরাই রামু (সুনীল), বারবারা দাশগুপ্তর নাম ঢুকিয়েছেন। প্রসঙ্গত, রামু দাশগুপ্ত পশ্চিমবঙ্গের। কমিউনিস্টের দেশকাল নেই। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের একজন কমিউনিস্টও রামু দাশগুপ্তকে পাত্তা দেন না। সম্পর্কও নেই ওঁদের সঙ্গে। জানেন, লোকটা চাপাবাজ এবং ফালতু। এ-ও বাহ্য। বার্লিনে বসবাসরত কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের একজন মানুষও তাকে, তার মিথ্যাচারিতার জন্যে পাত্তা দেন না। কোনো অনুষ্ঠানেও ডাকে না।

সত্যজিৎ রায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে-স্বাধীনতায় অবদান রেখেছেন? কবে? কখন? কোথায়? বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কলকাতায় মিছিল, সভা কম হয়নি। বুদ্ধিজীবী-শিল্পীসাহিত্যিক-সাংবাদিক-সাংস্কৃতিক কলাকুশলীর উদ্যোগে অন্তত কুড়িটি অনুষ্ঠান হয়েছে। অন্নদাশঙ্কর রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুচিত্রা মিত্র প্রমুখ অনুরোধ জানিয়েছেন ফোনে, অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্যে। মৃনাল সেন, চিšে§াহন সেহানবীশ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দীপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, পরিতোষ সেন, দেবেশ রায় জোট বেঁধে সত্যজিতের কাছে গিয়েছেন, মিছিলে-সভায় যোগ দেওয়ার জন্যে। আইভরি টাওয়ার থেকে কবে নেমেছেন? মানিকদা (সত্যজিৎ রায়) আমার প্রিয়। আমি ওঁর øেহভাজন। দুঃসময়ে সাহায্যও করেছেন নানাভাবে। সর্বদাই কৃতজ্ঞ ওঁর প্রতি। কৃতজ্ঞতা মানে এই নয়, কোনো অবদান ছাড়াই সম্মাননা মেনে নেওয়া। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে, স্বাধীনতায় অবদান রেখেছেন? কবে? কখন? কীভাবে?Ñ প্রমাণ চাই। বিস্তারিত।

কী আশ্চর্য!! সুচিত্রা মিত্রের নাম নেই প্রাপকের তালিকায়!!! দিনের পর দিন, মাসের পর কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের নানা শহর-গঞ্জে মানুষকে উদ্ধুদ্ধ করার জন্যে, সভা-সমিতি-মিছিলে বিনা পারিশ্রমিকে সুচিত্রা মিত্র ছাড়া কে গেয়েছেন। আমার সোনার বাংলা? ঃ হেমন্ত, মান্না দে? কলকাতার মুসলিম-এলাকা মেটিয়াবুরুজে গিয়ে সুচিত্রা মিত্র ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়ার সময় পাকিস্তানপন্থিদের আক্রমণের কথা ভুলে গেছি? হায়!! সুচিত্রা পান না সম্মাননা!!!

মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে সুচিত্রা মিত্র কতটা সরব ছিলেন গানে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানমালায়, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর একটি লেখায় প্রকাশিত।

স্বাধীনতা সম্মাননা প্রাপকের ফাইনাল তালিকা কোন মাফিয়ারা করেছে? কারা যুক্ত? শ্রীনগরের (কাশ্মির) সাইয়ীদ জাফর বাদ? বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতায় তার কী অবদান মাফিয়ারা জানে কি? জানে কি এই সাংবাদিককে (সাইয়ীদ জাফর) পাকিস্তানপন্থিরা হত্যা করেছিল? জানেন কি মৈত্রেয়ী দেবী, গৌরী আইয়ুবের অবদান? বিচারপতি মাসুদের অবদান? কে বিচারপতি মাসুদ?Ñ ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগে মাসুদের বাংলাপ্রেমের ভূমিকা কী, পড়-ন আবুল হাশিম, বদরুদ্দীন উমরের বই, জানবেন।

‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে বিচারপতি মাসুদের ভূমিকা আত্মত্যাগের চেয়েও ঐশ্বরিক।’ বলছেন শওকত ওসমান। ভুলে গেছি তাঁর কথা? সম্মাননা প্রাপক নন?Ñ না। মস্কোপন্থি ফাজিল কমিউনিস্ট-বুদ্ধিজীবীর তালিকায় তিনি নেই। যেমন নেই সতীকান্ত গুহ। বিশ্বের বৃহত্তম স্কুল ‘সাউথ পয়েন্ট’ (দক্ষিণ কলকাতায়, ৪৭ হাজার ছাত্রছাত্রী) এর মালিক। বাংলাদেশের শরণার্থীর জন্যে স্কুল বন্ধ করে আশ্রয়দান। ৩ মাস। বাংলাদেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে টেম্পোরারি নিয়োগ (স্কুল খুলে)। বেতনও দিয়েছেন ৯ মাস। থাকার ব্যবস্থাও করেছেন প্রত্যেকের। মুজিবনগরের সরকারকে এককালীন ২৩ লাখ টাকা সাহায্যও দিয়েছেন।Ñ সতীকান্ত গুহ কেউ নয় তবে মুক্তিযুদ্ধের অবদানে? যেমন নয় আসামের শিলচরের মহাত্মা ঘোষের? কে তিনি?Ñ খোঁজ করুন।

দেবুদা (দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়) আমার বয়সে বড়ো হলেও ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ঘরোয়া। পারিবারিকের চেয়ে অন্তরঙ্গ। হোক। সম্মাননা প্রাপক? কী আশ্চর্য!! মুক্তিযুদ্ধের গোটা নয় মাসে ‘সংবাদ পরিক্রমা’ লিখলেন প্রণবেশ সেন এবং প্রণবেশ সেনের নির্দেশেই (প্রণবেশ সেনই আকাশবাণী কলকাতার নিউজ বিভাগের ডেপুটি চিফ) দেবদুলাল পাঠক। গলা কাঁপিয়ে। প্রণবেশকে সম্মাননা নয়। দেবুকে?Ñ কী ফাজলামো! কী সম্মাননা প্রদান!!

অন্নদাশঙ্কর রায়ের কন্যা তৃপ্তি রায় কলকাতা থেকে আমাকে ফোন করে প্রশ্ন : ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার সম্মাননা প্রাপক আমার বাবা। বাবার পক্ষে সম্মাননা গ্রহণ করছেন সুরজিত দাশগুপ্ত। তিনি কে? কে দায়িত্ব দিয়েছে তাঁকে? বাংলাদেশ সরকার আমার সঙ্গে, আমার ছোড়দার (আনন্দরূপ রায়, এখন তিনি কলকাতায়) সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। আমার বাবা অন্নদাশঙ্কর রায়। ঃ বাবাকে অপমান। বাংলাদেশ সরকারের এই সম্মাননা প্রত্যাখ্যান করছি। আপনি লিখবেন, বাংলাদেশ সরকার আমাদের অপমান করেছেন’Ñকেবল কী অন্নদাশঙ্করকে? Ñআমাদের মুক্তিযুদ্ধকেও।

লেখক : কবি

৩০ মার্চ ২০১২

প্যারিস, ফ্রান্স

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন