বুধবার, ১৪ মার্চ, ২০১২

কেন ঘটবে বাংলা বসন্ত বা গণঅভ্যুত্থান?


১. অনেকে মনে করছেন বিশেষ করে যুব সমাজের উদ্যোগে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় যে গণজাগরণ তথা আরব বসন্ত সেখানকার রাজনীতিতে পরিবর্তন আনছে তার হাওয়া বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে। তাদের এই ধারণা যে অমূলক নয় তার প্রমাণ হয়েছে ‘আমরা শতকরা ৯৯ ভাগ’ স্লোগানে অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনের ধারায় বিশ্বের ১৮০টি দেশের ৯৫২ শহরে গণবিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এই গণবিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থানের হাওয়া এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে বিশ্বের জনসংখ্যা বিবেচনায় ৭ম রাষ্ট্র বাংলাদেশকে আলোড়িত করবে কি না। বাংলাদেশেও আরব বসন্তের ধাক্কা এসে লাগবে অনিবার্যভাবে—এমনটাই ভাবছেন অনেকে। আবার কেউ কেউ এরই মধ্যে ধারণা প্রকাশ করছেন যে, মধ্যপ্রাচ্য বা উত্তর আফ্রিকার পরিস্থিতি আর বাংলাদেশের পরিস্থিতি এক নয়। তিউনিসিয়া, মিসর, লিবিয়া, ইয়েমেন, মরক্কো, বাহরাইন, আলজিরিয়াসহ উত্তর আফ্রিকায় যে গণজাগরণ সূচিত হয়েছে তার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে, ওইসব দেশে দীর্ঘস্থায়ী একনায়কত্ববাদী এবং স্বৈরাচারী শাসন চলেছে। কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থা তেমন নয়।
কেউ কেউ মনে করেন, অনেকগুলো দল নিয়ে মহাজোট গঠন করে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও জনপ্রিয়তা নিয়ে একটি সরকার ক্ষমতায় আছে এবং তাদের সাংগঠনিক ভিত্তিও খুব মজবুত। সুতরাং এমন একটি সরকারের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান সহজ নয়। আবার কেউ কেউ বলছেন, গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে এই জালিম সরকারকে হটানো হবে।
২. সময়ই নির্ধারণ করবে বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান ঘটবে কি না। তবে এ ব্যাপারে অনেকেই নিশ্চিত যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবর্তন অনিবার্য। বাংলাদেশের রাজনীতির ছয় দশকের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে বুঝতে সহজ হবে যে, গণজাগরণ ও গণঅভ্যুত্থান এ দেশের মাটি ও মানুষের সঙ্গে মিশে আছে। যে জনপদ ও সীমানা নিয়ে আজকের বাংলাদেশ সেই জনপদের অধিবাসীরাই ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ দ্বিখণ্ডিত করে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে মুসলমানদের আবাসভূমি হিসেবে একটি নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। মাত্র কয়েক বছরর ব্যবধানে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে ১৯৫২ সালে গণঅভ্যুত্থানের সূচনা হয় এবং ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে গণজাগরণের ঢেউয়ের আঘাতে মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটে। মাত্র কয়েকটি আসন ছাড়া সব আসনে বিজয়ী হয় যুক্তফ্রন্ট। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ঘটে এক ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান এবং তারই ধারাবাহিকতায় সংঘটিত হয় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং পৃথিবীর বুকে অভ্যুত্থান ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের।
৩. বাংলাদেশের স্থপতি এবং প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অসাধারণ জনপ্রিয় ও জননন্দিত নেতা। কিন্তু জোয়ার-ভাটার এই দেশে মাত্র সাড়ে তিন বছরে তার জনপ্রিয়তার পারদ কতটা নিচে নেমে আসে যার ফলে এক সেনাঅভ্যুত্থানে তাঁকে সপরিবারে হত্যার অমানবিক ও মর্মান্তিক ঘটনার পর তত্কালীন সেনাপ্রধানসহ অত্যাধুনিক রক্ষীবাহিনী এবং তার বিশাল রাজনৈতিক দল ও জোট কেউ এগিয়ে আসেনি এই বর্বরোচিত ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে। বরং ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর লাখো জনতা রাজপথে নেমে এসে ঘটিয়েছিল আরেকটি গণঅভ্যুত্থান। দলীয় দৃষ্টিতে আজ এসবের যত ব্যাখ্যাই দেয়া হোক না কেন, যেভাবেই হোক ৭ নভেম্বর ছিল একটি গণজাগরণ ও গণঅভ্যুত্থান।
৪. একইভাবে ১৯৯০ সালে সামরিক স্বৈরাচারী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মতাদর্শের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সম্মিলিত সংগ্রামের মাধ্যমে ঘটেছিল আরেকটি গণঅভ্যুত্থান এবং পতন হয়েছিল স্বৈরশাসনের।
৫. রাজনীতি সচেতন এ দেশের মানুষ বারবার এটা প্রমাণ করেছে যে, তারাই রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি। জনগণ যখন আশাহত হয়েছে, প্রতারিত হয়েছে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখনই ওয়াদাভঙ্গ করেছে, নির্যাতন ও নিপীড়নে জনগণের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে তখনই এই দেশের সচেতন কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-জনতা জেগে উঠেছে। তারা রাজপথে নেমে এসেছে এবং সাধারণ মানুষই জীবন দিয়েছে, রক্ত দিয়েছে এবং অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে, রাজনীতির মানচিত্র বদলে দিয়েছে। এ জন্য নামকরা নেতারা, তাদের সন্তানরা নয়, বরং সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-যুবকরাই হয়েছে গণজাগরণ ও গণঅভ্যুত্থানের নায়ক।
৬. এমন কী পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে যে, দেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দেশ একটি গণঅভ্যুত্থানের মুখোমুখি? এই প্রশ্নের জবাবে প্রথম যে কথাটা আসে তাহলো, শতকরা ৮৭ ভাগ ভোটারের অংশগ্রহণে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে যে নির্বাচনটি হয়েছিল তা ছিল ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দীনের একটি সাজানো নির্বাচন। যার ফলে যতটা বিপুল জনসমর্থন নিয়ে সরকার ক্ষমতায় বসেছে বলে ধরে নেয়া হয়, তার ভিত্তিটা তত মজবুত নয় বা আসলেই এই সরকারের পক্ষের জনমতটা ছিল কৃত্রিম। সংসদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে মহাজোট সরকার বিরোধী দল ও ভিন্নমতকে অবমূল্যায়ন করছে। জোটের শরিক দলেরও পরামর্শ নিচ্ছে না। সব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে। দলের ভেতরেও সিনিয়র অনেক নেতা উপেক্ষিত। অদক্ষ ও অযোগ্য মন্ত্রী এবং অতিসক্রিয় উপদেষ্টাদের দ্বন্দ্ব এবং সমন্বয়হীনতা সরকারের কার্যকারিতা বিনষ্ট করে দিয়েছে।
৭. পর্বত-প্রমাণ অঙ্গীকার করে জনমনে যে আশাবাদ জাগানো হয়েছিল সরকারের নির্বাচনী ওয়াদা পূরণে চরম ব্যর্থতা তা হতাশায় পর্যবসিত হয়েছে। সন্ত্রাস, দুর্নীতি দমন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে আনা, ঘরে ঘরে চাকরির ব্যবস্থা, মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি সাধনে সরকারের ব্যর্থতায় মানুষের দুর্ভোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় তা গণবিক্ষোভে পরিণত হচ্ছে।
৮. দেশের দায়িত্ব গ্রহণের প্রথমদিন থেকে বিরোধী দল ও ভিন্নমতকে মাইনাস করে সর্বত্র দলীয়করণ এবং প্রশাসনে দলবাজি সৃষ্টি করে সরকার নিজেই সঙ্কট তৈরি করেছে। এতবেশি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ এবং দলীয় বিবেচনায় পদায়ন, বদলি এবং শত শত কর্মকর্তাকে ওএসডি বানিয়ে বসিয়ে রেখে প্রশাসনের গতিশীলতা নষ্ট করেছে। ফলে প্রশাসন এখন বিভাজিত ও অস্থির।
৯. দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, চাকরি দিতে ও সন্ত্রাস দমনে সরকারের ব্যর্থতা সত্ত্বেও গণবিক্ষোভ এতটা বাড়ত না। কিন্তু সরকারি দলের লোকদের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলদারিত্ব, চাকরি বাণিজ্য, ঘুষ-দুর্নীতি, ক্ষমতার দাপট, লুটপাটের ব্যাপারগুলো সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার ফলেই মানুষের মনে প্রতিনিয়ত ক্ষোভ বাড়ছে।
১০. জনগণের মৌলিক সমস্যা, দারিদ্র্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, শিল্প-কারখানা স্থাপন, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা বিধানের ব্যাপারে তত্পর হওয়ার পরিবর্তে সরকারের পুরোশক্তি অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় এবং বেহুদা কাজে ব্যয় হচ্ছে। রাস্তাঘাটের বেহাল দশা, নৌপথ অচল, দখল হয়ে যাচ্ছে নদী-খাল-বিল, রাজধানীর যানজটে অতিষ্ঠ নগরজীবন। অথচ সরকার ব্যস্ত বিমানবন্দর, সেতু ও প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন—পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, উড়াল সড়ক, বঙ্গবন্ধুর নামে আরেকটি নতুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও শহর নির্মাণের মেগা প্রজেক্ট, অপ্রয়োজনীয়ভাবে নতুন বিভাগ এবং সিটি কর্পোরেশন ঘোষণা বা ঐতিহ্যবাহী রাজধানী ঢাকা সিটি কর্পোরেশন দু’ভাগে বিভক্ত করা কিংবা বিনা নির্বাচনেই ৬১টি জেলা পরিষদে উপমন্ত্রীর পদমর্যাদায় দলীয় লোকদের প্রশাসক নিয়োগ করার মতো বিষয়গুলো নিয়ে।
১১. প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রী বা সরকারি দলের পাতি নেতারাও ব্যস্ত রাজনৈতিক বক্তব্য তথা বিরোধী দলকে গালাগাল করার কাজে। মন্ত্রীদের বক্তব্য শুনে বোঝার উপায় নেই, তিনি কোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন। বিরোধী দলের বিরুদ্ধে হরহামেশা একতরফা প্রচার চালাচ্ছে বিটিভি।
১২. বেড়ে চলছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু, গুম ও নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা। পুলিশ, র্যাব, স্বাধীন দেশের নাগরিকদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের অনেকের লাশ পাওয়া যাচ্ছে কিংবা অনেকের লাশও পাওয়া যাচ্ছে না।
১৩. বিরোধী দল সভা-সমাবেশ-মিছিল করলেই তাদের লাঠিপেটা করা হচ্ছে কিংবা গুলি চালিয়ে হত্যা করা হচ্ছে কিংবা হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সরকারি কাজে বাধাদান, গাড়ি পোড়ানো, পুলিশের ওপর হামলা ইত্যাদি নানা অভিযোগে মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো হচ্ছে। রাজনৈতিক দলের অফিস পর্যন্ত খুলতে দেয়া হচ্ছে না। স্বাভাবিক মিটিং-বৈঠক থেকে গ্রেফতার করে গোপন বৈঠক ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে।
১৪. গণতন্ত্রের নামাবলী গায়ে দিয়ে কার্যত একদলীয় সংসদ চালানো হচ্ছে। প্রধান বিরোধী দল বিএপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের নাম বাংলাদেশ থেকে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করার জন্য যা করার দরকার তার সবকিছুই করা হচ্ছে। যে বাড়িটি জিয়া পরিবারকে দান করা হয়েছিল এবং যেখানে বেগম খালেদা জিয়া ২৮ বছর ধরে বসবাস করে আসছিলেন সেখান থেকে তাকে জোরপূর্বক উত্খাত করা হয়েছে। উপরন্তু তার এবং তার সন্তান ও বিরোধী দলের অনেক নেতার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। পক্ষান্তরে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে অনেক দুর্নীতি ও হত্যা মামলাসহ রাজনৈতিক বিবেচনায় দশ হাজার মামলা প্রত্যাহার করার সুপারিশ করা হয়েছে এবং এরই মধ্যে সুপারিশকৃত অধিকাংশ মামলা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষ এটাকে সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহার এবং বিরোধী দলের প্রতি অন্যায় আচরণ বলে মনে করছে।
১৫. ৪০ বছর পর যুদ্ধাপরাধী বিচারের ইস্যু নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে এবং তা নিয়ে অতিরিক্ত মাতামাতি করছে সেটা দেশের ভেতরে এবং বাইরে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছে। ১৯৫ জন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনটি পাস করা হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের বিচার না করে মরহুম শেখ মুজিবের সরকার তাদের পাকিস্তানে ফেরত পাঠায় ত্রিদেশীয় দিল্লী চুক্তির ভিত্তিতে। অথচ সম্প্রতি আইনটি সংশোধন করে জামায়াতে ইসলামী এবং বিএনপির নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। জামায়াতের সাবেক আমির ৮৯ বছর বয়স্ক অধ্যাপক গোলাম আযমসহ ৬ জন শীর্ষ জামায়াত নেতা এবং বিএনপির ২ জন বিশিষ্ট নেতাকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারের নামে প্রহসন করা হচ্ছে। ১৯৭৩ সালের এই আইনটি একটি কালো আইন। এই আইনের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকার সংস্থা এবং বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা আপত্তি জানিয়েছেন এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে এই প্রহসনের বিচারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে তীব্র সমালোচনা করা হচ্ছে। বিএনপি-জামায়াতের কোটি কোটি সমর্থকসহ সাধারণ দেশবাসী স্বাভাবিকভাবেই এই বিচার প্রক্রিয়াকে মেনে নিতে পারছে না। জনগণ ধরেই নিয়েছে যে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তথা বিরোধী দলকে দুর্বল করার জন্যই সরকার এই ইস্যুটি ব্যবহার করছে।
১৬. প্রথমবার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ ১৯৭৫ সালে বহুদলীয় গণতন্ত্র হত্যা করে একদলীয় বাকশালী শাসন জাতির ওপর চাপিয়ে দিয়ে যে মারাত্মক ভুল করেছিল, এবার দেশের মানুষের মতামত উপেক্ষা করে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে কেয়ারটেকার সরকারব্যবস্থা বাতিল এবং ধর্মনিরপেক্ষতা চালুসহ বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক বিধি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে ফের সেই ভুলেরই পুনরাবৃত্তি করেছে। ৭-এর ক এ ৭(খ) সংযোজনের মাধ্যমে জনগণের এবং খোদ জাতীয় সংসদের অধিকার হরণের মতো অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জাতির ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে পঞ্চদশ সংশোধনীতে। সংবিধানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে কোনো আলোচনা-সমালোচনা, সংশোধন-সংযোজন বা রহিতকরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যে কোনো অজুহাতে নাগরিককে রাষ্ট্রদ্রোহিতার সর্বোচ্চ শাস্তির চরম অগণতান্ত্রিক বিধান হয়েছে।
১৭. একদলীয় স্বৈরাচারী শাসনে বিশ্বাসী শেখ হাসিনা-এরশাদের মহাজোট জাতীয় সংসদকে একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠান এবং দলীয় ক্লাবে পরিণত করেছে। সম্প্রতি South Asians for Human Rights (SAHR) নামক একটি প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পার্লামেন্টে মানবাধিকার উপেক্ষিত। বর্তমান এই পার্লামেন্টে ১৮০০ মনোযোগ আকর্ষণের নোটিশের মধ্যে মাত্র ৪৭টি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে গত তিন বছরে। জনগণের সম্পদ ও সংসদের মূল্যবান সময় নষ্ট করে শাসক দলের এমপিরা তাদের দল ও নেতার প্রশংসা করেছেন ৬১৬ বার এবং বিরোধীদলের সমালোচনা করেছেন ৮০৮ বার। সংসদকে পাশ কাটিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইন পাস করা হয়েছে। সংস্থাটির গবেষণা পত্রে বলা হয়েছে, তিন বছরে ৭টি অধিবেশনে জাতীয় সংসদ আইন প্রণয়ন কাজে ব্যয় করেছে মাত্র ৪৭ ঘণ্টা। অথচ সংসদের কার্যঘণ্টা ছিল ৫৭৬ ঘণ্টার ওপরে। গড়ে একটি আইন পাস করতে ২১ মিনিট সময় নিয়েছে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন উত্তর ও দক্ষিণ এই দু’ভাগে বিভক্ত করার একটি আজব বিল সংসদে পাস করা হয় মাত্র দুই মিনিটে।
১৮. বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে নানা চুক্তি সম্পাদন, জাতীয় নিরাপত্তা উপেক্ষা করে ট্রানজিট ও বন্দর ব্যবহারের সুবিধা প্রদান, গঙ্গা ও তিস্তাসহ দুই দেশের ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে ব্যর্থতা, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী কর্তৃক পাখির মতো গুলি করে বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা ও অকথ্য নির্যাতনের অব্যাহত ঘটনা বন্ধে ভারত-বান্ধব শেখ হাসিনা সরকারের ব্যর্থতা দল মত নির্বিশেষে সব বাংলাদেশীর মাঝে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। ভারতের আগ্রাসী নীতি এবং শেখ হাসিনা সরকারের মাত্রাতিরিক্ত ভারতপ্রীতির প্রতি ক্ষোভ যে কতটা প্রচণ্ড রূপ নিয়েছে সম্প্রতি বাংলাদেশী তরুণদের দ্বারা ভারতের বিরুদ্ধে ঘোষিত সাইবার যুদ্ধের ঘটনার মধ্য দিয়েই তার প্রকাশ ঘটেছে। বাংলাদেশের তরুণরা ভারতের ২০ হাজারের বেশি ওয়েবসাইট হ্যাক করে দিয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তিগত দিক থেকে এবং দেশপ্রেমের উদ্দীপনায় বাংলাদেশের তরুণরা তাদের সক্ষমতারই স্বাক্ষর রেখেছে।
১৯. শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির ফলে ৩৫ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে এবং ২৫ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ায় পুঁজিবাজার একটি ভয়ঙ্কর সঙ্কটে নিপতিত হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীরাই শেয়ারবাজার লুটপাটের এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হওয়ায় সরকার কোনো ব্যবস্থাই দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে গ্রহণ করতে পারেনি বা করেনি। ফলে শেয়ারবাজারের পতন অব্যাহতই রয়েছে। সরকার বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য মাত্রাতিরিক্ত ব্যাংক লোন গ্রহণ করায় বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে গেছে। বিদেশি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। মুদ্রাস্ফীতি শতকরা ১০ ভাগের ওপর। দুর্নীতির কারণে পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ হয়ে গেছে।
২০. বিগত তিন বছরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং বড় বড় কলেজগুলোতে সন্ত্রাস, সংঘাত ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব, ভর্তি বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য এবং নিজেদের মধ্যেই খুনোখুনির ঘটনা ঘটিয়েছে এবং এসবের বিরুদ্ধে সরকার কোনো কার্যকর ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি। প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের সাংগঠনিক দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করলেও দেশব্যাপী ছাত্রলীগের লাগামহীন বাড়াবাড়ি ও নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে দেশবাসী অতিষ্ঠ এবং বৃহত্তর ছাত্রসমাজ দারুণভাবে বিক্ষুব্ধ ও এই পরিস্থিতির উত্তরণ চায় তারা। সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, সাধারণ ছাত্ররাই সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের তাণ্ডবের যথাবিহিত জাবাব দিতে এগিয়ে আসছে। তিন বছরে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে সাহস করেনি সরকার।
২১. সরকারের তিন বছরের শাসনকালের মধ্যে জাতীয় জীবনে সবচেয়ে বড় ক্ষত সৃষ্টিকারী ঘটনা বিডিআর সদর দফতরে সেনা কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ড। তথাকথিত বিডিআর বিদ্রোহের এই ঘটনায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো যুদ্ধেও একদিনে একটি ঘটনায় একসঙ্গে এত বিপুল সংখ্যক সেনা কর্মকর্তা নিহত হওয়ার ঘটনা বিরল। এত বিপুল সংখ্যক মেধাবী, প্রতিভাবান ও সম্ভাবনাময় সেনা কর্মকর্তা হারানোর বেদনা সেনাবাহিনী, নিহতদের পরিবার, আত্মীয়-স্বজন এবং দেশবাসী কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। তথাকথিত বিডিআর বিদ্রোহ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পদক্ষেপ নিলে এত বড় মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হতো না বলে প্রায় সব সাবেক সেনা কর্মকর্তা এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বিডিআর সদর দফতরে সেনা কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ডের জন্য দেশের মানুষ সরকারকেই প্রধানত দায়ী মনে করে। আবার আট সহস্রাধিক বিডিআর সদস্যকে কারারুদ্ধ করে অকথ্য নির্যাতন এবং বিচারের নামে যে ভয়ঙ্কর প্রহসন হচ্ছে তা যে একটা সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। চাকরি হারিয়ে এবং আর্থিকভাবে বঞ্চিত হওয়ার ফলে হাজার হাজার বিডিআর পরিবার কঠিন ও দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। উপরন্তু বিডিআর বিদ্রোহের জের ধরে অনেক সেনা কর্মকর্তার চাকরিচ্যুতিসহ নানা শাস্তির ঘটনা ঘটেছে। শেষ পর্যন্ত ঐতিহ্যবাহী বিডিআরের নাম পরিবর্তন করে বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) করা হয়েছে, যা দেশের মানুষ পছন্দ করেনি।
২২. সর্বশেষ ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের যে ঘটনা সম্প্রতি ঘটা করে প্রচার করা হয়েছে এবং ‘ধর্মান্ধ ব্যক্তি’রা জড়িত বলে উল্লেখ করে পশ্চিমা শক্তির সহানুভূতি লাভের প্রয়াস চালানো হচ্ছে সে ব্যাপারেও দেশের মানুষ বিভ্রান্ত। সংবাদ সম্মেলন করে এ ধরনের ঘটনার প্রচার চালিয়ে মহল বিশেষকে দায়ী করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের কৌশল দেশের সচেতন নাগরিক সমাজ মোটেই পছন্দ করেনি। ব্যর্থ অভ্যুত্থানের এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেও সৃষ্টি হয়েছে বিভ্রান্তি ও ধূম্রজাল। মানুষ অপেক্ষা করছে তদন্তের ফলাফল দেখার জন্য।
২৩. বিভিন্ন সমীক্ষা, পর্যবেক্ষণ এবং সংবাদপত্রের প্রতিদিনের অনলাইন জরিপ থেকে এটা পরিষ্কার যে, সরকারের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেছে। ফলে সরকারি দলের লোকেরা তাদের ভবিষ্যত্ নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং আস্থা হারিয়ে ফেলেছে ও বেসামাল আচরণ করছে। সরকার হতাশাগ্রস্ত হওয়ার কারণে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে বাধা দিচ্ছে বা পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে দেউলিয়াত্ব প্রকাশ করছে। জনমত যে কতটা সরকারের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে তার একটি চাক্ষুস প্রমাণ আড়িয়ল বিলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ। এলাকার আবালবৃদ্ধ-বনিতা লাঠি-সড়কি, দা-কুড়াল নিয়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং পুলিশ কর্মকর্তাকেও বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে জীবন দিতে হয় এবং সরকারেরও এখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর স্থাপনের কর্মসূচি বাতিল করতে হয়। আড়িয়ল বিলের গণজাগরণের ঘটনাকে বলা যায় একটি মিনি গণঅভ্যুত্থান। সুতরাং সংক্ষিপ্ত পরিসরে যে প্রেক্ষিতগুলো তুলে ধরা হয়েছে তাতে এটা ধরে নেয়া যায় যে, আরব বসন্তের মতোই বাংলা বসন্ত তথা গণঅভ্যুত্থান ঘটাটা অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। তাছাড়া রাজনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে বাংলাদেশের মানুষ খুব বেশি একটা সময় নেয় না।
আ বু ল ও য়া ফী

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন