রবিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

বাংলা ভাগ : দায় কার


১৯ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বিশ্ববাঙালি সম্মেলন হয়ে গেল। এই উপলক্ষে ঢাকায় এসেছিলেন বিদেশে বসবাসরত কিছু গুণী বাঙালি ব্যক্তিত্ব। তার সিংহভাগটি এসেছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে। বিশ্বব্যাপী বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ২৫ কোটি। এই ২৫ কোটির মধ্যে ১৬ কোটিরই বাস বাংলাদেশে। বাংলাদেশের বাইরে বাংলা ভাষাভাষী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোর মধ্যে রয়েছে—ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসামের কয়েকটি জেলা এবং ত্রিপুরা রাজ্য। এপার বাংলা-ওপার বাংলা বলে একটি বচন ইদানীং খুব বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। আওয়ামী লীগ যখনই দেশের শাসনক্ষমতায় আসে তখনই এপার বাংলা-ওপার বাংলা বলে হুলুস্থুল পড়ে যায়। কিন্তু নিষ্ঠুর সত্যটি হলো, এপার বাংলা-ওপার বাংলা নয়—ওপার ভারত। আমি যখন নয়াদিল্লিতে অবস্থিত জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণারত ছিলাম, তখন দিল্লিতে বাংলাদেশ মিশনে ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর আয়োজিত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশী ছাত্র হিসেবে নিমন্ত্রণ পেতাম। সেই সময় ভারতে আমাদের হাইকমিশনার ছিলেন বিশিষ্ট কূটনীতিক ফারুক চৌধুরী। যতদূর জানি ফারুক চৌধুরী এখন আওয়ামী লীগের একজন উপদেষ্টা। সংবাদপত্রে তার লেখা প্রকাশিত হলে মনোযোগ দিয়ে পড়ার চেষ্টা করি। তার ভাষা সাবলীল, বর্ণনাভঙ্গি চমত্কার এবং তার লেখায় শেখার মতো অনেক কিছুই থাকে। দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের উপরোল্লিখিত একটি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশী ছাত্রদের মধ্যে কেউ কেউ এপার বাংলা-ওপার বাংলা বলে সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে ফারুক চৌধুরী দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন—আমি এপার বাংলা-ওপার বাংলা তত্ত্বে বিশ্বাসী নই। ওদের সঙ্গে আমাদের অনেক ফারাক। স্মৃতির কারণে আমার যদি বিভ্রম না ঘটে থাকে তাহলে বলব, ফারুক চৌধুরী এভাবেই তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন।
এবার আরেক টুকরো স্মৃতির কথা বলতে চাই। এই স্মৃতিটি অত্যন্ত মূল্যবান। ১৯৭২ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশের স্থপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার সুগন্ধা কার্যালয়ে এক সন্ধ্যায় প্রায় ঘণ্টা তিনেক আলাপ হয়েছিল। অনেক প্রসঙ্গেই তিনি খোলামেলা অনেক কথা বলেছিলেন। তার সঙ্গে দেখা হতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, মওলানা সাহেব (মওলানা ভাসানী) কী বলেন। আমার জবাব ছিল, আমার চেয়ে আপনিই তো ভালো জানেন। তিনি তো বলছেন বাংলাদেশ অসম্পূর্ণ। এখনও ১৪টি জেলা বাংলাদেশের বাইরে রয়ে গেছে। ওগুলো বাংলাদেশে এলেই বাংলাদেশ সম্পূর্ণ হবে। আমি তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, এ ব্যাপারে আপনার মত কী। তিনি অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে বললেন, স্লোগানটা প্রিমেচিউর। আগে ওদের দিল্লি থেকে বের হয়ে আসতে দে। তারপর ভেবে দেখব ওদের নেয়া যায় কিনা। তার চিন্তা-ভাবনায় কোনো অস্বচ্ছতা ছিল না। বাঙালির ঐক্য তার কাছে বাংলাদেশের স্বাধীন-সার্বভৌম সত্তা বিলীন করে ভারতের বাঙালিদের সঙ্গে এক হয়ে যাওয়া নয়। কোনো দূরভবিষ্যতে বাংলা ভাষাভাষীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রশ্ন উঠলে তার জন্য যে প্রাথমিক শর্তটি পূরণ করতে হবে, তা হলো যেসব বাংলা ভাষাভাষী দিল্লির কর্তৃত্বাধীন রয়েছে তাদের সেই কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত হওয়া। অন্যথায় এই ঐক্যের কথা ভাবাই যায় না। যদি অন্য বাংলাভাষীরা দিল্লির কর্তৃত্বমুক্ত হয় তাহলেও শেখ মুজিবুর রহমান তাদের তাত্ক্ষণিকভাবে বরণ করে নেয়ার কথা ভাবেননি। তিনি বলেছিলেন, তারপর দেখব ওদের নেয়া যায় কি-না। বাংলাভাষীদের জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্নে আমাদের প্রাজ্ঞ নেতাদের মধ্যে চিন্তার পার্থক্য অত্যন্ত স্পষ্ট। কেন এই পার্থক্য তা নিয়ে খুব গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা হয় কিনা সন্দেহ আছে। মওলানা ভাসানী কী কারণে সেই ১৯৭২ সালে বাংলাদেশকে অসম্পূর্ণ বলেছিলেন, তা ভাসানী অনুসারীরা তার কাছ থেকে জানতে চেয়েছিল কি-না তা আমার জানা নেই। তবে বাংলাদেশের ৪০ বছর পূর্ণ হওয়ার ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা থেকে একথা উপলব্ধি করা কারোর জন্যই কঠিন নয় যে, বাংলাদেশের ওপর ভারতের আগ্রাসী থাবার ছোবল ক্রমাগতই বিষময় হয়ে উঠছে। মওলানা ভাসানী সেদিন এমন কথা উচ্চারণ করে প্রকারান্তরে যা বলতে চেয়েছেন তা হলো, ভারতের আগ্রাসী থাবার বিরুদ্ধে প্রয়োজনে প্রতিরোধাত্মক কৌশল হিসেবে সমগ্র বাংলাভাষীকে নিয়ে দিল্লির কর্তৃত্বমুক্ত বৃহত্তর বাংলা গঠনের স্লোগান উঠতে পারে। আমি অবশ্য ব্যক্তিগতগতভাবে এই সম্ভাবনা নাকচ করি। গণচীনের জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই এক সময় বলেছিলেন, পৃথিবীর তাবত্ বিভক্ত জাতি একদিন ঐক্যবদ্ধ হবে। তার সেই ভবিষ্যদ্বাণী ফলেছে উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম এবং পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির একত্রীকরণের মধ্য দিয়ে। এখনও গণচীন ও তাইওয়ানের একত্রীকরণ এবং উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার একত্রীকরণ সম্ভব হয়নি। তবে রাজনৈতিক পর্যায়ে এসব একত্রীকরণের প্রয়াস আছে। কিন্তু বাংলাভাষীদের একত্রীকরণ আমার কাছে অলীক স্বপ্নমাত্র মনে হয়। এর কারণ বহুবিধ। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হওয়ার পর কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু ভদ্রলোকদের নেতৃত্বে বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য তীব্র গণআন্দোলন গড়ে উঠেছিল। তাদের বিক্ষুব্ধ হওয়ার মূল কারণ ছিল, পূর্ববঙ্গের হতদরিদ্র কৃষককুলের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও শোষণ হারানোর আশঙ্কা। সেদিন বাংলাদেশকে মায়ের অঙ্গচ্ছেদের সঙ্গে তুলনা করেছিল হিন্দু ভদ্রলোকরা। ১৬ অক্টোবর ১৯০৫ আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা দেয়া হয়। হিন্দু ভদ্রলোক নেতৃত্বের উদ্যোগে দিনটি ‘শোক দিবস’ হিসেবে পালন করা হয় এবং কলকাতায় ফেডারেল হলের শিলান্যাস করা হয়। এই ফেডারেল হলেই পরবর্তীকালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হতো। ১৬ অক্টোবরের সভা থেকে স্বদেশি আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয় এবং বঙ্গভঙ্গবিরোধীরা ‘বন্দেমাতরম’কে রণধ্বনি হিসেবে গ্রহণ করে। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের প্রধান নেতারা ছিলেন গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, মতিলাল ঘোষ, আনন্দমোহন বসু, রমেশচন্দ্র দত্ত, বিপীনচন্দ্র পাল, অশ্বিনী কুমার দত্ত, অম্বিকাচরণ মজুমদার ও একে মিত্র। এই প্রসঙ্গে কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ লিখেছেন, ‘উভয় বঙ্গের মুসলমানদের ভেতর বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধ আন্দোলনে খুব অল্প সংখ্যক মুসলমান যোগ দিয়েছিলেন। তাদের ভেতর মিস্টার আবদুর রসুল (ব্যারিস্টার), আবদুল হালীম গজনবী (পরে স্যার আবদুল হালীম গজনবী), মৌলভী মনিরুজ্জামান ইসলাম আজাদী, মৌলভী কাজেম আলী (কাজেম আলী মাস্টার নামে খ্যাত ছিলেন), সৈয়দ ইসমাইল হোসাইন সিরাজী, বর্ধমানের মৌলভী আবুল কাশেম, মৌলভী মুজিবুর রহমান (দি মুসলমান নামক ইংরেজি সাপ্তাহিকের সম্পাদক), মৌলভী মুহম্মদ আকরম খাঁ (তখন ঢাকার ‘আজাদ’ পত্রিকার মালিক), পাটনার মিস্টার আলী ইমাম (পরে স্যার আলী ইমাম), তার ভ্রাতা মিস্টার হাসসান ইমাম, মিস্টার মুজহারুল হক ব্যারিস্টার (পরে পাটনার সাদাকত আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা), মৌলভী লিয়াকত হোসাইন, ডাক্তার আবদুল গফুর সিদ্দিকী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
আমি বঙ্গভঙ্গের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে কোনো আন্দোলনেই যোগ দিইনি। তখন আমার যে বয়স ছিল তাতে কোনো এক পক্ষে যোগ দিলে আমার জন্য তা মোটেই বেমানান হতো না। আমার বয়সের ছেলেরা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। তবে সাম্প্রদায়িক কোনো ব্যাপারে আমি একেবারেই যোগ দিইনি একথা বললে সত্যের অপলাপ করা হবে! বিশেষ মুসলিম দাবি-দাওয়ার সভা-সমিতিতে আমি যোগ দিয়েছি। আমি সে সময়ে ধার্মিক মুসলমান ছিলাম। দিনে পাঁচবার নামাজ না পড়লেও রমজানের পুরো মাস উপবাস করতাম।’
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তার ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি ৭ সেপ্টেম্বর ১৯০৫ (২২ ভাদ্র ১৩১২) সঞ্জিবনী পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ৭ আগস্ট ১৯০৫ কলকাতা টাউন হলের সভায় এই গানটি বাউল সুরে গীত হয়েছিল। বর্তমানে এই গানটিই বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গে ক্ষুব্ধ ও আবেগাপ্লুত হয়ে আরও অনেক গান ও প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। তিনি লিখলেন, ‘বাঙালির প্রাণ বাঙালির মন/বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন/এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান।’ এটিই ছিল বিখ্যাত ‘রাখিসঙ্গীত’। তিনি আরও লিখলেন, ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি/তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী!/ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফেরে!/তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে\’ জননীরূপী বাংলাদেশের এই অপরূপ ছবি আমাদের মনে স্বদেশপ্রীতির অনুভবকে জাগ্রত করে। এই গানটি স্বদেশপ্রেমের গান হিসেবে বাংলাদেশের নানা অনুষ্ঠানে দরদভরা কণ্ঠে গীত হয়। এই গানটিও রচিত হয়েছিল বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনকে উজ্জীবিত করতে। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথ লিখলেন—‘ও আমার দেশের মাটি’, ‘সার্থক জন্ম আমার’ ইত্যাদি। কিন্তু অচিরেই রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করলেন, বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্বদেশি আন্দোলনে মুসলমানদের উত্সাহিত বোধ করার কোনো কারণ নেই। তিনি তার ‘ব্যাধি ও প্রতিকার’ প্রবন্ধে লিখলেন—“আজ আমাদের ইংরেজি পড়া শহরের লোক যখন নিরক্ষর গ্রামের লোকের কাছে গিয়ে বলে, ‘আমরা উভয়েই ভাই’—তখন এই ভাই কথাটির মানে সে বেচারা কিছুই বুঝিতে পারে না। যাহাদিগকে আমরা ‘চাষাবেটা’ বলিয়া জানি, যাহাদের সুখদুঃখের মূল্য আমাদের কাছে অতি সামান্য, যাহাদের অবস্থা জানিতে হইলে আমাদিগকে গভর্নমেন্টের প্রকাশিত তথ্যতালিকা পড়িতে হয়, সুদিনে দুর্দিনে আমরা যাহাদের ছায়া মাড়াই না, আজ হঠাত্ ইংরেজের প্রতি স্পর্ধা প্রকাশ করিবার বেলায় তাহাদের নিকট ভাই সম্পর্কের পরিচয় দিয়া তাহাদিগকে চড়া দামে জিনিস কিনিতে ও গুর্খার গুঁতা খাইতে আহ্বান করিলে আমাদের উদ্দেশ্যের প্রতি সন্দেহ জন্মিবার কথা। সন্দেহ জন্মিয়াও ছিল। কোন বিখ্যাত ‘স্বদেশী’ প্রচারকের নিকট শুনিয়াছি যে পূর্ববঙ্গে মুসলমান শ্রোতারা তাঁহাদের বক্তৃতা শুনিয়া পরস্পর বলাবলি করিয়াছে যে, বাবুরা বোধ করি বিপদে ঠেকিয়াছে। ইহাতে তাহারা বিরক্ত হইয়াছিলেন, কিন্তু চাষা ঠিক বুঝিয়াছিল। বাবুদের স্নেহভাষণের মধ্যে ঠিক সুরটা যে লাগে না তাহা তাহাদের বুঝিতে বিলম্ব হয় নাই। উদ্দেশ্য সাধনের উপলক্ষে প্রেমের সম্বন্ধ পাতাইতে গেলে ক্ষুদ্র ব্যক্তির কাছেও তাহা বিস্বাদ বোধ হয়—সে উদ্দেশ্য খুব বড় হইতে পারে, হউক তাহার নাম ‘বয়কট’ বা ‘স্বরাজ’ দেশের উন্নতি বা আর কিছু।” রবীন্দ্রনাথের মতো মানবতাবাদী কবিও বুঝতে পেরেছিলেন, হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কে কোথায় একটা বিরাট দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। আর সেই জন্যই মুসলমানরা বঙ্গভঙ্গের আন্দোলনে একাত্ম হতে পারেনি।
পরবর্তীকালের অভিজ্ঞতা আরও করুণ। ১৯৪৬-৪৭ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম এবং শরত্ বসু স্বাধীন-সার্বভৌম যুক্তবাংলা গঠনের প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। যুক্তবাংলার পরিকল্পনাটি ছিল অনেকটা দিবাস্বপ্নের মতো। গান্ধী এই পরিকল্পনার প্রতি শর্তসাপেক্ষ অনুমোদন দিয়েছিলেন। গান্ধী নিজেই স্বীকার করেছেন, কংগ্রেস কার্যকরী কমিটি তাকে শরত্ বসুর পরিকল্পনার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করায় ভর্ত্সনা করে। সুতরাং তিনি এর প্রতি সমর্থন প্রত্যাহারে বাধ্য হন। কংগ্রেস নেতা বল্লভভাই প্যাটেল বাঙালি হিন্দুদের আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ‘Bengal cannot be isolated from the Indian Union. Talk of a Sovereign Republic of Independent Bengal is a trap to induce the unwary and the unwise to enter the parlour of the Muslim League. The Congress working committee is fully aware of the situation in Bengal, and you need not be afraid at all. Bengal has got to be partitioned, if the non Muslim population is to survive.’ এ ব্যাপারে প্যাটেল ও জওহরলাল নেহরুর মধ্যে চিন্তার কোনো পার্থক্য ছিল না। কংগ্রেস নেতা জেবি কৃপালনি আশরাফউদ্দীন চৌধুরীকে লিখেছিলেন, ‘All that the Congress seeks to do today is to rescue as many as possible from the threatened domination of the League and Pakistan. It wants to save as much territory for a free Indian Union as possible under the circumstances. It therefore insist upon the division of Bengal and Punjab... I do not see what else Congress can do under the circumstances.’ হিন্দু মহাসভা নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিও প্রবলভাবে বাংলাভাগের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার ইচ্ছার সঙ্গে একাত্ম হয়েছিল বাংলার হিন্দু জনগোষ্ঠী। তারা অবিভক্ত স্বাধীন বাংলায় মুসলিম কর্তৃত্বে বাস করার চেয়ে বৃহত্ ভারতের একটি রাজ্যের নাগরিক হওয়াই শ্রেয় মনে করেছেন। বাংলা ভাগ তাই অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল। ১৯০৫-এ যারা বাংলা ভাগকে মায়ের অঙ্গচ্ছেদের সঙ্গে তুলনা করেছিল, তারাই আবার ১৯৪৭-এ মায়ের অঙ্গচ্ছেদের পক্ষেই দাঁড়াল। আমরা সত্যকে কঠিন বলি। এটি তেমনি এক সত্য ছিল।
বিশ্ববাঙালি সম্মেলনে পঠিত এক প্রবন্ধে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘রাজনৈতিক নানা কারণে এবং ইতিহাসের ঘটনাক্রমে প্রাচীন বাংলাদেশ এখন বিভক্ত। কিন্তু বাঙালির একাত্মতার ভিত্তি প্রধানত রাজনৈতিক নয়। সাহিত্য, কাব্য, সঙ্গীত এবং চিন্তানির্ভর সভ্যতার ঐক্যের জোর রাজনীতি থেকে কম নয়। তারই সঙ্গে আছে আমাদের সমাজ চেতনার চিন্তামুখী আলোপ-আলোচনা। তার প্রভাব রাজনীতির ওপর পড়বে না, এমনটি নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু সেই নৈকট্যের ভিত্তি একমাত্র রাজনীতিতে নয়। বিশ্ববাঙালির সম্মেলন সেই একতাটিকে আরেকটু বড় করবে। যেমন করেছিল ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের উত্সব।’ পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত আরেক অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় একটি প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের আলোচনায় বললেন, ‘ভূমি ভাগ করা যায়, মাকে ভাগ করা যায় না।’ অমর্ত্য সেনকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে, বাংলা ভাষাভাষীদের ঐক্যের ভিত্তি কেন মূলত রাজনৈতিক নয়। হিন্দু ভদ্রলোকদের রাজনীতি এবং পরবর্তীকালে কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার জেদাজেদির ফলেই তো বাংলা ভাগ হয়েছে। শুধু গান গেয়ে, সাহিত্য আলোচনা করে কিংবা উচ্চমার্গের তত্ত্বদর্শনের ব্যবচ্ছেদে লিপ্ত হয়ে এই ভাগ মুছবে না। এই ভাগকে পরম ও চরম বলে মনে করা হয় বলেই অভিন্ন নদীর পানি আটকে দেয়া হয়, সীমান্তে গুলি করে বাংলাদেশীদের হত্যা করা হয় এবং বাংলাদেশের প্রতি উপহাস করে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে পণ্যসামগ্রী নেয়ার জন্য বছরে ১ লাখ টাকা করে দেয়া হচ্ছে। বিভেদের এই মৌলিক কারণগুলো দূর না করে শুধু উত্সব অনুষ্ঠানের আয়োজন করলে কী কাজে আসবে?
লেখক : অর্থনীতিবিদ
mahbub.ullah@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন