রবিবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১২

আইএসপিআরের ভাষা : ‘অসত্য’ ‘কাণ্ডজ্ঞানহীন’ ‘উস্কানিমূলক’ ‘অনভিপ্রেত’


আমার লেখার শুরুতেই বলে রাখি, আজকের এই লেখাটি পড়ে যারা বিরক্ত হবেন, রুষ্ট হবেন; তারা যে-ই হোন না কেন, দয়া করে আমাকে গুম কিংবা খুন করবেন না। আমার বিরুদ্ধে কোনো মামলাও দেবেন না। রিমান্ডে নিয়ে যেসব করা হয়, সেসব দোহাই আল্লাহর আমার ওপর প্রয়োগ করবেন না। আমার মতো সামান্য একজন কবির অত ধকল সইবার মতো শারীরিক ফিটনেস নেই।
এত কথা বলার পর কেউ তো প্রশ্ন করতেই পারেন, তাহলে এ লেখার দরকার কী? দরকার আছে বৈকি। এ লেখা লিখছি আমাদের মাতৃভূমির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের স্বার্থে। সেনাবাহিনীকে যারা নিজেদের দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করে, এর ভাবমূর্তি ও গ্রহণযোগ্যতা ধ্বংস করতে চায়—তাদের মতলব উন্মোচনের স্বার্থে। আরও যদি বলেন তাহলে বলবো, প্রাণের টানে। এছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্য নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুনসহ আরও দু’একজন বুদ্ধিজীবী যখন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নিরন্তর কলম চালনা করে প্রায়ই লিখে যাচ্ছিলেন বাংলাদেশে সেনাবাহিনীরই দরকার নেই, তখন দেশের হাতেগোনা যে দুই-চারজন সেনাবাহিনীর পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন, আমি তাদের একজন।
মুনতাসির মামুনরা তখন যুক্তি দেখাচ্ছিলেন, বাংলাদেশ গরিব দেশ, সেনাবাহিনীর মতো এত বিশাল শ্বেতহস্তীর ভরণ-পোষণ করতে গিয়ে জাতীয় অর্থনীতির বারোটা বেজেছে। তাছাড়া আমাদের চারদিকে যেহেতু বন্ধু দেশ ভারত, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান বন্ধু, সেহেতু আমাদের তো কোনো শত্রুই নেই। তারা সে সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে তথাকথিত শান্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর বীরোচিত ভূমিকা পালনে রীতিমত উষ্মা প্রকাশ করে সেখান থেকে সেনা প্রত্যাহারেরও দাবি জানিয়ে আসছিলেন প্রতিনিয়ত। তাছাড়া শান্তিবহিনী ও তাদের আশ্রয়দাতা ভারতীয়দের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সব হত্যাকাণ্ড, খুন, ধর্ষণের দায়ও চাপাচ্ছিলেন আমাদের সেনাবাহিনীর ওপর।
সেইসব সিন্ডিকেটেড প্রপাগান্ডার বিরুদ্ধে আমরা বলেছি, ভারতের ৫০ ভাগ মানুষ বাস করে দারিদ্র্যসীমার নিচে। ৪০ ভাগ মানুষ সারা দিনে একবেলা খেতে পায় না। ৩০ ভাগ সম্পূর্ণ ভাসমান জীবন যাপন করে। সেখানে তো সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কেউ কথা বলে না। উল্টো সমর শক্তির পেছনে সীমাহীন ব্যয় বৃদ্ধির সপক্ষেই সবাই সাফাই গায়।
আমাদের চারদিকে বন্ধু দেশ ভারত বলেই তো আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণে শক্তিশালী সেনাবাহিনী দরকার। আগাগোড়া ভারত হলো সম্প্রসারণবাদী এবং অত্যন্ত আগ্রাসী মনোভাবাপন্ন। তাদের মতো বন্ধু পাশে ছিল বলেই তো আজ স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ সিকিম ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য। ভারতের মতো প্রতিবেশী থাকলে কী পরিণতি হতে পারে তার জ্বলন্ত নজীর তো স্বাধীন-সার্বভৌম ‘হায়দারাবাদ’। আজকের প্রজন্মের যারা ঢাকায় বসে ইদানীং ‘হায়দারাবাদের বিরানী খেয়ে রসনা তৃপ্ত করে, তারা তো জানেও না যে হায়দারাবাদ ছিল একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। মাত্র ৬ দিনের যুদ্ধে ১৯৪৯ সালে ভারত এই দেশটি দখল করে। ভবিষ্যতে যাতে আর কেউ এ দেশের জন্য ন্যূনতম প্রতিরোধ গড়তে না পারে সেজন্য অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা, মধ্যপ্রদেশের মধ্যে ভাগাভাগি করে দেয় দেশটির ভূখণ্ড। আজকের হায়দারাবাদ বলতে টিকে আছে শুধু হায়দারাবাদ শহরটি।
স্বাধীন হায়দারাবাদের শেষ প্রধানমন্ত্রী স্যার মীর লায়েক আলী তার ‘ট্রাজেডি আর হায়দারাবাদ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ভারত যখন তার ৬ ডিভিশন সৈন্য নিয়ে হায়দারাবাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, সে সময় হায়দারাবাদের স্থায়ী প্রতিনিধি জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে চিত্কার করে বলছিলেন, ‘ভারত আমার দেশ দখল করে নিচ্ছে। তোমরা একটা কিছু কর। হায়দারাবাদকে বাঁচাও।’ শক্তিশালী ভারত, তার বন্ধু যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের কারণে সেদিন নিরাপত্তা পরিষদ একটি প্রস্তাবও নিতে পারেনি।
স্যার লায়েক আলী লিখেছেন, ভারতকে বিশ্বাস করে আমরা একটি ভালো বিমান বাহিনী গড়িনি। ভারত-নির্ভরতার জন্য সেনাবাহিনীকেও শক্তিশালী করিনি সে রকমভাবে। সেই ভুলের সুযোগে ভারত দখল করে নিল হায়দারাবাদ।
আমরা লিখেছি, ভারতের চার পাশের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে একটা দেশের নাম বলুন, যে দেশটি ভারত সম্পর্কে সামান্যতম ভালো কথা বলে। বা তারা ভারতকে বিশ্বাস করে। ভারতের জন্য নেপালের ঘুম হারাম। পাকিস্তান থাকে সারাক্ষণ তটস্থ। তামিলদের লেলিয়ে দিয়ে সর্বনাশ করে দিয়েছে শ্রীলঙ্কার। চীনের সঙ্গে তার সম্পর্ক যুদ্ধংদেহী। সেজন্য সেই ভারতের কারণেই, ভারতকে আক্রমণ করার জন্য নয়, নিজেদের রাষ্ট্রিক নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করার স্বার্থেই শক্তিশালী সেনাবাহিনী আমাদের দরকার।
পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনা প্রত্যাহার হবে রাষ্ট্রঘাতী। তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে সব অপকর্মের জন্য দায়ী শান্তিবাহিনী। সেনাবাহিনী বরং প্রাণপণ চেষ্টা করে রক্ষা করছে দেশের সার্বভৌমত্ব ও শান্তি।
পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের উছিলায় মধ্যযুগীয় বর্বরতায় সেনাবাহিনীর মেধাবী অফিসারদের হত্যাকাণ্ডে যারা ক্ষুব্ধ ক্রুদ্ধ ব্যথিত হয়ে চোখের পানি ফেলেছেন, আমিও তাদের একজন। এখনও যারা মনে করে পিলখানা ট্র্যাজেডির সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি, যারা মনে করে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার হতেই হবে—আমি তাদের একজন।

দুই.
সেনাবাহিনীর প্রতি আমার মতো মমতা বেশিরভাগ বাংলাদেশের মানুষের। কারণ তারা জানে, এই সেনাবাহিনী মুক্তিযুুদ্ধের ঘোষণাকারী। সাতজন ‘বীরশ্রেষ্ঠ’র সবাই ছিলেন সেনাসদস্য। এই সেনাবাহিনী মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত, দেশপ্রেমিক। তাদের মধ্য থেকে কখনও কদাচিত্ এরশাদ কিংবা মইন উ’র মতো ‘বর্জ্য’ নির্গত হলেও তার দায় কখনোই কেউ পুরো সেনাবাহিনীর ঘাড়ে চাপায়নি। চাপানোর চিন্তাও করেনি।
সেই ভরসায় বলি, গত ৯ জানুয়ারি চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক পলো গ্রাউন্ড ময়দানে স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভায় চিএনপির চেয়ারপার্সন, দেশের তিন তিন বারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বক্তৃতার ওপর আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) পত্র-পত্রিকায় প্রচার ও প্রকাশের জন্য ‘অসত্য, উস্কানিমূলক, কাণ্ডজ্ঞানহীন ও অনভিপ্রেত’ বলে যে বিবৃতি দিয়েছে, তা পাঠ করে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক জনগণ মর্মাহত হয়েছে, বিভ্রান্ত হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমিও দুঃখ পেয়েছি। বেশিরভাগ মানুষের বক্তব্য, এই ধরনের আক্রমণাত্মক, অশোভন শব্দ সেনাবাহিনীর মতো একটি সুশৃঙ্খল প্রতিষ্ঠানের জনসংযোগ পরিদফতর থেকে ব্যবহার করা মোটেই সঙ্গত হয়নি। আমাদের মনে রাখতে হবে, সেনাবাহিনী কোনো বিশেষ দলের পেটোয়া বাহিনী নয়। সেনাবাহিনী কোনো বিশেষ দলের মুখপাত্র নয়। তার রয়েছে নিজস্বতা। তাকে ঘিরে আছে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক জনতার শুভেচ্ছা ও দোয়া। সেজন্যই তারা দেশের সম্পদ, জাতির আপন অস্তিত্বের গর্বিত অংশ। অথচ যে বিবৃতিটি তারা দিয়েছে এটা আওয়ামী লীগের প্রচার সেল বা তার দফতর সম্পাদক কিংবা প্রচার সম্পাদক দ্বারা প্রণীত বলে মনে হয়েছে অনেকের।
বিবৃতিটা একটু দেখি, ‘সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করতে সেনা কর্মকর্তাদের গুম করা হচ্ছে’ মর্মে বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্যকে ‘কাণ্ডজ্ঞানহীন’ আখ্যা দিয়ে আইএসপিআর বলেছে, ‘এ ধরনের অসত্য, উস্কানিমূলক ও কাণ্ডজ্ঞানহীন বক্তব্য বিরোধী দলের নেতার দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত কোনো ব্যক্তিত্বর কাছ থেকে জাতি প্রত্যাশা করে না।’ আইএসপিআরের পরিচালকের পক্ষে সহকারী পরিচালক নূর ইসলাম স্বাক্ষরিত এই বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এর দ্বারা সেনাবাহিনীর মতো একটি জাতীয় শৃঙ্খলা বাহিনীর ভাবমূর্তি বিনষ্ট এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা করা হয়েছে।’
আমি আবারও বলি, এই ধরনের বিবৃতি পাঠ করে আমি খুবই হতাশ। আমি উদ্বিগ্ন বোধ করছি। বিবৃতির শব্দ ব্যবহার যেমন অমার্জিত, তেমনই রয়েছে ‘জ্ঞান’ দেয়ার প্রবণতা। পাশাপাশি রয়েছে ‘অভিযুক্ত’ করার পরিষ্কার প্রয়াস। এটা জবাব দেয়ার সঠিক পথ নয়। আর আইএসপিআর কেন রাজনৈতিক বক্তৃতা, যে বক্তৃতার লক্ষ্য ক্ষমতাসীন সরকারের সেনাবিরোধী কর্মকাণ্ড—তার বিরুদ্ধে বিবৃতি দিতে যাবে। বরং সেনাবাহিনী রক্ষার জন্য যে ‘আকুতি’ বেগম খালেদা জিয়ার বক্তৃতায় ফুটে উঠেছে, তাকে সাধুবাদ জানাবে। সেনাবাহিনীকে রক্ষা, তার ভাবমূর্তি রক্ষাই ছিল বেগম জিয়ার বক্তব্যের উদ্দেশ্য। যিনি সেনাবাহিনীকে রক্ষা করতে চান, তার বক্তব্যের বিরুদ্ধে আইএসপিআর অভিযোগ এনেছে ভাবমূর্তি বিনষ্টের, অভিযোগ এনেছে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টার।

তিন.
সঙ্গত কারণেই সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন সম্মানিত সিনিয়র কর্মকর্তা এ ধরনের ‘কাণ্ডজ্ঞানহীন’ সংবলিত বিবৃতি প্রত্যাহারের দাবি করেছেন। তারা বলেছেন, বেগম জিয়া তার বক্তৃতায় সেনাবাহিনীর বর্তমান অবস্থা তুলে ধরেছেন। সেনাবাহিনীর সুনাম ও মর্যাদা রক্ষার জন্য তিনি তাদের অবস্থা নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বাস্তব ঘটনা সম্পর্কে সঠিক তথ্য তুলে ধরেছেন।
তারা বলেছেন, জিয়াউর রহমান এদেশের আধুনিক সেনাবাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা। খালেদা জিয়া সেনাবাহিনীকে সমৃদ্ধ করতে ভূমিকা রেখেছেন। একজন অভিভাবকের অবস্থান থেকেই তিনি সেনাবাহিনীর সমস্যা তুলে ধরেছেন। আইএসপিআরকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার দুঃখজনক বলে তারা সরকারের সমালোচনা করেছেন।
ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রম অশোভন শব্দ ব্যবহারের নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, জিয়া পাঁচ ব্রিগেডের আর্মিকে ৫ ডিভিশন শক্তিসম্পন্ন বাহিনীতে পরিণত করেছিলেন। তিন বাহিনীর আধুনিকায়নের জন্য তার অবদান অতুলনীয়। খালেদা জিয়া তিন তিন বারের প্রধানমন্ত্রী, তিনি দীর্ঘ ১৯ বছর জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম করেছেন। তিনি দেশের একজন বিজ্ঞ অভিজ্ঞ রাজনীতিক। শহীদ জিয়ার হাতে গড়া সেনাবাহিনীতে কোনো সমস্যা হলে তিনি কষ্ট পান। তিনি তো একজন অভিভাবকও।
একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ব্যাপারে কী ধরনের ভাষা ব্যবহার করা যায়, তা ভেবে-চিন্তেই করা উচিত ছিল। মনে রাখতে হবে, কেউ সারাজীবন নিজের পদে অধিষ্ঠিত থাকবে না। তিনি বলেছেন, শুধু সশস্ত্র বাহিনী নয়, প্রতিটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকা উচিত।
সাবেক সেনাপ্রধান লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমানও বলেছেন, আইএসপিআরকে কখনোই রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা ঠিক নয়।

চার.
বিএনপি চেয়ারপার্সন বিরোধীদলীয় নেত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, এখন মানুষ গুম হচ্ছে প্রতিনিয়ত; এমনকি সেনাবাহিনী অফিসারদের গুম করা হচ্ছে। তার লক্ষ্য একটাই—বিডিআর ধ্বংস করেছে, এবার সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করবে। পরিকল্পিতভাবে এ দেশটিকে ভারতীয় করদরাজ্যে পরিণত করবে। সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করতে বেছে বেছে ভালো অনেক অফিসারকে মিথ্যা কথা বলে চাকরি থেকে বিদায় করে দেয়া হয়েছে। অনেককে গুম করা হয়েছে। অনেককে বন্দি করে বিচার করা হচ্ছে। অনেককে জেলেও রাখা হয়েছে। এটার লক্ষ্য একটাই—সেনাবাহিনী ধ্বংস করে দেয়া।
আপনাদের মনে থাকতে পারে, স্বাধীনতার পর ভারত বলেছিল বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো সেনাবাহিনী থাকবে না। প্রতিরক্ষা বাহিনী থাকবে না। তাদের সঙ্গে ২৫ বছরের গোলামী চুক্তির এটি একটি ধারা ছিল; সে জন্যই সেই জিনিসটিই আবার আওয়ামী লীগ ফিরিয়ে এনেছে। তারা সেনাবাহিনীকে এভাবে ধ্বংস করে দিয়ে ভারতের অনুগত, আওয়ামী লীগের অনুগত লোকদের দিয়ে রক্ষীবাহিনীর মতো একটি বাহিনী রাখতে চায়। যার জন্য আপনারা দেখেছেন, ’৭১ থেকে ’৭৫ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিল, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ছিল ছোট আকারে এবং মাত্র ৪টি ব্রিগেড ছিল। তাও তাদের জুতা ছিল না, মোজা ছিল না, ইউনিফর্ম ছিল না, থাকার জায়গা ছিল না। তাদের ঠিকমত খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা ছিল না।
অন্যদিকে রক্ষীবাহিনীর জন্য আলিশান বিল্ডিং করে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও সুন্দর ইউনিফর্ম দেয়া হয়েছিল। তারা চেয়েছিল বাংলাদেশের নামমাত্র সেনাবাহিনী থাকবে। আর রক্ষীবাহিনী দিয়ে লুণ্ঠন করবে এবং এদের দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার দেশ পরিচালনা করবে আজীবন। আর জনগণকে ভারতের তাঁবেদার হয়ে থাকতে হবে। সমাবেশে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছি একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে থাকার জন্য, পিন্ডির শৃঙ্খল ভেঙে দিল্লির শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকার জন্য নয়। কিন্তু এই আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকলে সেই স্বাধীনতা আমাদের থাকবে না।’
এরকম একটি দায়িত্বশীল বক্তৃতা কীভাবে কাণ্ডজ্ঞানহীন হতে পারে, আমাদের বোধগম্য নয়। যাদের গায়ে বিঁধার কথা, তারা পর্দার আড়ালে থেকে সামনে ঠেলে দিয়েছে আইএসপিআরকে। আইএসপিআরের কর্তারা হয়তো প্রতিরক্ষামন্ত্রীর নির্দেশ পালন করেছেন মাত্র!

পাঁচ.
বেগম খালেদা জিয়ার ৯ জানুয়ারির বক্তৃতার বিরুদ্ধে আইএসপিআর বিবৃতি দিলে, সঙ্গত কারণেই বিএনপিকে একটা জবাব দিতে হয়েছে। এবার দেখা যাক বিএনপির বিবৃতি :
সরকারের সমালোচনার জবাব দেয়ার দায়িত্ব সশস্ত্র বাহিনীর নয়। বিএনপি মনে করে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত থাকায় তার অধীন প্রতিষ্ঠান আইএসপিআরকে বিরোধীদলীয় নেতার বক্তব্যের অপব্যাখ্যা দেয়ার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে।
বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়, সরকার রাষ্ট্রের একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং সশস্ত্র বাহিনী রাজনীতির ঊর্ধ্বে একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান। বিরোধীদলীয় নেতা সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও কার্যকলাপ সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করলে সেই সমালোচনা সশস্ত্র বাহিনীকে লক্ষ্য করে করা হয়েছে বলে প্রচার করাটা নিছক অপপ্রচার ও অপব্যাখ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। সরকারের বিরুদ্ধে যে সমালোচনা তার জবাব দেয়ার দায়-দায়িত্বও সশস্ত্র বাহিনীর নয়।
প্রেস বিজ্ঞপ্তির শেষদিকে বলা হয়, সেনাবাহিনীর পরিচালন রীতি, সেনা আইন এবং শৃঙ্খলা বিধানের পদ্ধতি সম্পর্কে বিরোধীদলীয় নেতা সম্যক অবহিত রয়েছেন। তার ভাষণের মূল নির্যাস ছিল, প্রতিষ্ঠিত সেই সব রীতি, আইন ও পদ্ধতির ব্যত্যয় ঘটিয়ে বর্তমান সরকারই এই বাহিনীকে দুর্বল করছে। বিরোধীদলীয় নেতার এসব অভিযোগের জবাব না দিয়ে উদ্দেশ্যমূলক ও বিভ্রান্তিকর প্রচারণা দেশবাসীর কাঙ্ক্ষিত, বাঞ্ছিত ও কাম্য নয়। আইএসপিআরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিরোধীদলীয় নেতার বক্তব্য সম্পর্কে ‘উস্কানিমূলক, কাণ্ডজ্ঞানহীন এবং অনভিপ্রেত’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার খুবই অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক উল্লেখ করে প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শক্তিশালী ও সুশৃঙ্খল সশস্ত্র বাহিনী গঠন এবং এই বাহিনীর ভাবমর্যাদা রক্ষা ও বৃদ্ধির ক্ষেত্রে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। কাজেই দেশনেত্রী সম্পর্কে এ ধরনের অভিযোগই প্রকৃতপক্ষে বিভ্রান্তিমূলক।
আইএসপিআরকে দিয়ে সরকার এ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করিয়েছে উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সশস্ত্র বাহিনীতে বর্তমান সরকারের বিভিন্ন পদক্ষপের কারণে যে বিভ্রান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, সে সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশের অধিকার দেশপ্রেমিক ও দায়িত্বশীল বিরোধী দলের অবশ্যই রয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম, সরকার দেশবাসীকে অন্ধকারে না রেখে এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও দায়িত্বশীল বক্তব্য দেবে। তা না করে আইএসপিআরকে ব্যবহারের মাধ্যমে বিরোধীদলীয় নেত্রীর ভাষণ সম্পর্কে অসংযত ভাষায় বক্তব্য প্রচার করিয়ে সরকারই উস্কানিমূলক কাজ করেছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর কারও হদিস পাওয়া না গেলে তিনি গুম হয়েছেন বলাই স্বাভাবিক। গত তিন বছরে বেশ ক’জন সেনা কর্মকর্তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া এবং তাদের অবস্থান সম্পর্কে পরিবার-পরিজনকে কোনো কিছু না জানানোর ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত ও বিভিন্ন সামাজিক নেটওয়ার্ক মারফত প্রচারিত হয়ে আসছে। নিরুদ্দিষ্ট সেনা কর্মকর্তাদের সম্পর্কে বিরোধীদলীয় নেতা সে কথাই বলেছেন মাত্র। এতে আরও বলা হয়, খালেদা জিয়া তার ভাষণে স্বাধীনতার পর থেকেই সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি আওয়ামী লীগ সরকারের অবজ্ঞা ও উপেক্ষা এবং সশস্ত্র বাহিনীর সমান্তরালে রক্ষীবাহিনী গঠনের বিবরণ তুলে ধরে বলেছেন, এতেই প্রমাণ হয় আওয়ামী লীগ শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী চায় না। বর্তমান সরকারের আমলে পিলখানা হত্যাকাণ্ডে নির্মমভাবে সেনা কর্মকর্তাদের নিহত হওয়ার ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেছেন, আগামীতে ওই মর্মন্তুদ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও উপযুক্ত বিচার করা হবে।
বিএনপির এই ‘দায়িত্বশীল’ বিবৃতিটিকে আশা করি আর কেউ ‘কাণ্ডজ্ঞানহীন’ বলে উড়িয়ে দেবে না। আশা করি সব ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটবে। আশা করি আমাদের সেনাবাহিনীও তার আসল শত্রু সম্পর্কে সচেতন হবে। আশা করি আইএসপিআরের ঘাড়ে বন্দুক রেখে আর কেউ পাখি শিকার করতে পারবে না।

ছয়.
আমাদের সেনাবাহিনীর রণসঙ্গীত :
‘চল চল চল
ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল
নিম্নে উতলা ধরণী তল
অরুণ প্রাতের তরুণ দল
চলরে চল চল’-টি নেয়া হয়েছে আমাদের জাতীয় কবির রচনা থেকে। এটাও আমাদের একটা গর্বের অংশ। সে জন্যই জাতীয় কবির ভাবমূর্তির মতো স্বচ্ছ, সুন্দর ও সাবলীল থাকুন আমাদের সেনাবাহিনী। জাতীয় কবির মতো দৃঢ়তা, আপসহীনতা, আধিপত্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতায় অফুরন্ত দেশপ্রেমের উত্স হয়ে ঘরের শত্রু ও বাইরের শত্রু মোকাবিলায় যথার্থ অর্থে তত্পর হোক সেনাবাহিনী। ‘ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত’ তারা আনুক রাঙা প্রভাত। তাই বলে ভুলেও সামরিক শাসন নয়। গণতান্ত্রিক জীবনকে কণ্টকমুক্ত রাখার জন্য তারা চিনুক শত্রুকে, মিত্রকে। এটুকুই আমজনতার কামনা।
a_hyesikder@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন