বুধবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১১

ভারতের ১০০ কোটি ডলার ঋণ -প্রকল্প ২০টি, বাস্তবায়ন হয়নি একটিও

ভারতের ১০০ কোটি ডলার (আট হাজার কোটি টাকার বেশি) ঋণের একটি প্রকল্পও বাস্তবায়িত হয়নি। ঋণচুক্তির আওতায় বাংলাদেশের প্রস্তাবিত ২০ প্রকল্পের মধ্যে ভারত এখন পর্যন্ত ১৩টির অনুমোদন দিয়েছে। সাতটি এখনো অনুমোদন পায়নি।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, ১০০ কোটি ডলারের ঋণ-প্রস্তাব দেওয়ার পর প্রায় দুই বছর চলে গেছে। আর ঋণচুক্তি সইয়ের পর পেরিয়ে গেছে ১৬ মাস। কিন্তু এখন পর্যন্ত এক ডলারও ছাড় করেনি ভারত।
তবে পররাষ্ট্র, যোগাযোগ ও রেল মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে ঋণচুক্তি বাস্তবায়নে সময় লাগছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায়ও এ অভিমত দেওয়া হয়েছে। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঋণচুক্তি বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয়হীনতার বিষয়টি উঠে আসে। বিভিন্ন সময় ভারতের পক্ষ থেকে প্রকল্পের অস্পষ্টতা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চিঠির জবাব দেরিতে পাঠানো হয়েছে। তখন আবার যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে তাতে বিষয়টির সুরাহা হয়নি। এতে মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয়হীনতা প্রকাশ পেয়েছে।
২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরের সময় বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। একই বছরের ৭ আগস্ট ভারতের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) এ-সংক্রান্ত ঋণচুক্তি সই হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি সফর শেষে সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ১০০ কোটি ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতিই তাঁর সফরের সবচেয়ে বড় অর্জন। অথচ এখন পর্যন্ত কোনো টাকা পায়নি বাংলাদেশ।
এই অর্থ সামনে রেখে ২০টি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ। সেগুলো জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন পেয়েছে। এর মধ্যে ভারতের অনুমোদন দেওয়া ১৩টি প্রকল্পের আর্থিক পরিমাণ ৭৫ কোটি ডলার। কেনাকাটার শর্তের জটিলতায় এখনো সাতটি প্রকল্পের অনুমোদন পাওয়া যায়নি ভারতের।
যোগাযোগ করা হলে ইআরডির সচিব ইকবাল মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ভারতীয় ঋণের অগ্রগতি নিয়ে কাজ করছি। এক টাকাও পাওয়া যায়নি এটা সত্যি, তবে রেলওয়ে খাতের প্রকল্প নিয়ে বেশ অগ্রগতি হয়েছে। অন্য প্রকল্পগুলোর জট দ্রুত খুলবে। শিগগিরই ভারতীয় ঋণের অর্থে কেনা বাস বাংলাদেশে আসবে।’
যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভারতীয় হাইকমিশনের এক কর্মকর্তা বলেন, ঋণচুক্তির বাস্তবায়ন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। পুরো প্রক্রিয়ায় যথেষ্ট অগ্রগতিও হয়েছে। বেশির ভাগ প্রকল্প অবকাঠামো নির্মাণসংক্রান্ত হওয়ায় এগুলো বাস্তবায়নে প্রক্রিয়াগত কারণে কিছুটা সময় লাগছে। তবে জানুয়ারির প্রথমার্ধেই ঢাকায় ভারত থেকে বাস চলে আসবে।
হাইকমিশনের একটি সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত ভারত যে প্রকল্পগুলোর ছাড় দিয়েছে, তার বেশির ভাগই রেলের। বাংলাদেশের প্রস্তাবিত বাজেট বেশি হওয়ায় রেলের প্রকল্পগুলোতে চুক্তির অতিরিক্ত টাকা বাংলাদেশকে মঞ্জুরি হিসেবে দেওয়া হবে।
সংকটের উৎস সমন্বয়হীনতায়: নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, বিভিন্ন সময় কিছু প্রকল্পের ব্যাপারে দিল্লির পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হলে তা নিয়ে সময়ক্ষেপণ করা হয়েছে। ভারতের চিঠির বিষয়ে কখনো কখনো ইআরডি সরাসরি জবাব দিয়েছে। ফলে অস্পষ্টতা দূর না হওয়ায় পুনরায় ভারতের পক্ষ থেকে তাগিদ দেওয়া হয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। এসব কারণে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি।
মসিউর রহমানের সভাপতিত্বে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতাবিষয়ক এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। বৈঠকে সমন্বয় বাড়ানোর তাগিদ দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত বলেন, এসব প্রকল্পের অনেক শর্ত। আবার এর সঙ্গে ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার অবকাঠামো উন্নয়নের বিষয়টিও জড়িত। তাই ঋণের অর্থ ছাড় নিয়ে বেশি অগ্রগতি হয়নি। তাঁর মতে, আমলাতান্ত্রিক উদ্যোগের পাশাপাশি রাজনৈতিক উদ্যোগ নিয়ে এসব প্রকল্পের অর্থ ছাড় করা উচিত।
প্রকল্প পরিস্থিতি: জানা গেছে, একটি শর্তের কারণে ভারতের অনুমোদন না পাওয়া সাতটি প্রকল্পে অগ্রগতি নেই। শর্তটি হলো, প্রকল্পের ঋণের ৮৫ শতাংশ কেনাকাটা ভারত থেকে করতে হবে। এসব প্রকল্পের বেশির ভাগ কাজই পূর্ত-সংক্রান্ত অর্থাৎ মাটি ভরাট, রাস্তা নির্মাণ, ইট-সিমেন্ট ব্যবহার ইত্যাদি। ঋণের শর্ত মানলে ইট, বালু, মাটি এমনকি শ্রমিক পর্যন্ত ভারত থেকে আনতে হবে।
প্রকল্পগুলো হলো: আশুগঞ্জ কনটেইনার বন্দর নির্মাণ, সরাইল-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সুলতানপুর-চিনাইর-আখাউড়া-সেনারবদি স্থলবন্দর পর্যন্ত সড়ককে জাতীয় মহাসড়কে উন্নীত করা, বারইয়ারহাট-রামগড়-সাবরুম স্থলবন্দর পর্যন্ত সড়ক উন্নয়ন, লালমনিরহাট-বুড়িমারী সড়ক উন্নয়ন, ঢাকার জুরাইন রেললাইন ওভারপাস নির্মাণ, বিএসটিআই আধুনিক ও শক্তিশালী করা এবং ব্রডগেজে চলাচল-উপযোগী ১২৫টি যাত্রীবাহী বগি সংগ্রহ প্রকল্প।
ইআরডির সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, কেনাকাটার শর্ত শিথিল করতে ইতিমধ্যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ১২ ডিসেম্বর এ নিয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর কাছে কী পরিমাণ মালামাল ও শ্রম স্থানীয় উৎস থেকে নিতে হবে, তা জানতে চেয়েছে ইআরডি।
ইআরডির তৈরি সর্বশেষ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ভারতের অনুমোদিত ১৩টি প্রকল্পের মধ্যে দুটিতে কার্যাদেশ দেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্প দুটি হলো, ৩০০টি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত দোতলা ও একতলা বাস এবং ১৮০টি ব্রডগেজ ট্যাংক ওয়াগন ও ছয়টি বগি ব্রেকভ্যান সংগ্রহ।
ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, এই দুটি প্রকল্পে বাস্তবায়নজনিত কোনো প্রক্রিয়া নেই। মূল কাজ হলো, সরাসরি বাস ও ওয়াগন কেনা। এসব বাস ও ওয়াগন পুরোপুরি তৈরি অবস্থায় ভারত থেকে বাংলাদেশে আসবে। অন্যদিকে, ওয়াগন কেনার প্রকল্পের জন্য শিগগিরই রূপালী ব্যাংকে এলসি খোলা হচ্ছে। চুক্তির শর্ত হিসেবে সব বাস ও ওয়াগন আসছে ভারত থেকে।
অনুমোদন পেলেও দরপত্র-প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি এমন প্রকল্পগুলো হলো: খুলনা-মংলা রেললাইন নির্মাণ, দ্বিতীয় ভৈরব ও দ্বিতীয় তিতাস সেতুতে সংযোগ রেললাইন নির্মাণ, রেলওয়ের জন্য ১০টি ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট সংগ্রহ, ছয়টি ড্রেজার কেনা, ৫০টি এমজি ফ্ল্যাট ওয়াগন ও পাঁচটি এমজি ভ্যান এয়ার ব্রেক কনটেইনার সংগ্রহ, ৩০টি ব্রডগেজ ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ সংগ্রহ, ১০টি ব্রডগেজ ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ সংগ্রহ, বিমানের জ্বালানি পরিবহনের জন্য ১০০টি এমজি বগি ট্যাংক ওয়াগন ও পাঁচটি এমজি ব্রেকভ্যান এয়ার ব্রেক যন্ত্রপাতি কেনা, ১৭০টি এমজি ফ্ল্যাট ওয়াগন ও ১১টি বগি ব্রেকভ্যান সংগ্রহ, ২৬৪টি এমটি যাত্রীবাহী ক্যারেজ ও দুটি বিজি পরিদর্শন কার সংগ্রহ এবং ১৫০টি এমজি যাত্রীবাহী ক্যারেজ সংগ্রহ প্রকল্প।
এর মধ্যে শেষ দুটি প্রকল্পে দরপত্র আহ্বান করা হলেও কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাতে অংশ নেয়নি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন