বৃহস্পতিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১১

বাড়িভাড়া লাগামছাড়া


২২ বছরে বাড়িভাড়া বেড়েছে ৩২৫ শতাংশ

নিয়ন্ত্রণ আইন আছে প্রয়োগ নেই

ঠুঁটো জগন্নাথ সিটি করপোরেশন


মাসের শুরুতে শুধু বাড়িভাড়াই দিতে হচ্ছে ১০ হাজার টাকা। পানি, বিদ্যুৎ আর গ্যাসের বিল তো আছেই। আমার মাসিক আয়ের ৭০ শতাংশই চলে যাচ্ছে বাড়িওয়ালার পকেটে।’ রাজধানীর মিরপুরে কাজীপাড়ার বাসিন্দা গোলাম রব্বানী বাড়িভাড়া নিয়ে তার বিড়ম্বনা এভাবেই তুলে ধরেন।

পোষাকশিল্প প্রতিষ্ঠানের এই কর্মকর্তা জানান, এ বছরের শুরুতে ভাড়া বাড়ানো সত্ত্বেও বাজেট ঘোষণার পর আবারও বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন বাড়িওয়ালা। অথচ বাড়িতে কোনও সুযোগ-সুবিধা বাড়াননি তিনি। এভাবে চলতে থাকলে তো একসময় বাড়িভাড়া দেওয়ার পর মাসের খরচ মেটানো আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।

রাজধানী জুড়ে রব্বানীর মতো বিপাকে আছেন প্রায় সব ভাড়াটিয়া। যাতায়াত, গ্যাস, পানি ও পণ্যমূল্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাড়িভাড়া। ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ বছরে একবারের জন্যও হোল্ডিংট্যাক্স বাড়েনি, অথচ অনেক বাড়িওয়ালা ইচ্ছামতো (বছরে অন্তত দুবার, জানুয়ারি এবং জুলাইয়ে) বাড়িভাড়া বাড়াচ্ছেন। আর এভাবেই বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল শহরে পরিণত হচ্ছে রাজধানী ঢাকা।

চলতি বছর ভাড়া বৃদ্ধির হার এলাকাভেদে ১ থেকে ৮ হাজার টাকা। উচ্চ-মধ্যবিত্তদের হিসাব বাদ দিলে রাজধানীতে সর্বনিম্ন ভাড়া ৬ হাজার এবং সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা।

ক্যাবের (কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) জরিপ অনুযায়ী, গত ২২ বছরে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ৩২৫ শতাংশ। ১৯৯০ সালে বাড়িভাড়া বৃদ্ধির হার ছিল ২৫ দশমিক ৭৯ ভাগ, ১৯৯১ সালে ২১ দশমিক ৬৫ ভাগ, ১৯৯২ সালে ১৩ দশমিক ৪৩ ভাগ, ১৯৯৩ সালে ১২ দশমিক ১৬ ভাগ, ১৯৯৪ সালে ১৬ দশমিক ৪৪ ভাগ, ১৯৯৫ সালে ২২ দশমিক ৬১ ভাগ, ১৯৯৬ সালে ১৭ দশমিক ৮৬ ভাগ, ১৯৯৭ সালে ১৫ দশমিক ০৩ ভাগ, ১৯৯৮ সালে ১৪ দশমিক ০৯ ভাগ, ১৯৯৯ সালে ১৮ দশমিক ২৪ ভাগ, ২০০০ সালে ১৫ দশমিক ০৮ ভাগ, ২০০১ সালে ১৭ দশমিক ৪০ ভাগ, ২০০২ সালে ১৩ দশমিক ৪৯ ভাগ, ২০০৩ সালে ৮ দশমিক ৪০ ভাগ, ২০০৪ সালে ৯ দশমিক ৯৬ ভাগ, ২০০৫ সালে ৭ দশমিক ৮৯ ভাগ, ২০০৬ সালে ১৪ দশমিক ১৪ ভাগ, ২০০৭ সালে ২১ দশমিক ৪৮ ভাগ, ২০০৮ সালে ২১ দশমিক ০৭ ভাগ, ২০০৯ সালে ১৪ দশমিক ৮৫ ভাগ এবং ২০১০ সালে এসে তা দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ২৭ ভাগে।

রুটিন মাফিক বাড়িভাড়া বাড়ানো অনেক বাড়িওয়ালার রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। জুন-জুলাইয়ে নতুন পে-স্কেলের সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় দফা বাড়ানো হয়েছে বাড়িভাড়া। ভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রেও এক মাসের বাড়িভাড়া অগ্রিম নেওয়ার বিষয়টি নীতিমালা রয়েছে। তবে কমপক্ষে ২ বা ৩ মাসের অগ্রিম ছাড়া কথাই বলতে চান না বাড়িওয়ালারা। বাড়িভাড়া দেওয়ার সময় তারা চুক্তিপত্রের মূলকপি নিজের কাছে রেখে দেন, ভাড়াটিয়াকে দেন ফটোকপি। কখনও তা-ও দেওয়া হয় না। কোনও সমস্যা হলে ভাড়াটিয়াদের পড়তে হয় বিপাকে। কারণ আদালতে চুক্তিপত্রের ফটোকপি গ্রহণযোগ্য নয়। অনেকক্ষেত্রে বাড়িওয়ালারা আবাসনের উদ্দেশ্যে বাড়ি তৈরি করে ভাড়া দেন বাণিজ্যিকভাবে, এতে অনেক বেশি ভাড়া পাওয়া যায়। অন্যদিকে বাণিজ্যিক ভবনের কর থেকে বঞ্চিত হয় সরকার।

ক্যাব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল এবং পরিবেশ বিভাগের জরিপ অনুযায়ী, ঢাকা শহরের দেড় কোটি জনসংখ্যার ৯০ শতাংশই ভাড়াটিয়া। এর ৭০ শতাংশ চাকরিজীবী। তারা বেতনের ৬০ শতাংশ বাড়িভাড়ায় ব্যয় করেন। ক্যাবের গবেষণা অনুযায়ীÑ ঢাকা শহরের জীবনযাত্রার মান ও আয় অনুযায়ী মোট বেতনের ২০ শতাংশের বেশি ব্যয় হলে তা জীবন চালানোর জন্য খুবই কঠিন হয়ে পড়ে।

আইন আছে, প্রয়োগ নেই : ১৯৯১ সালে প্রবর্তিত ‘বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন’ বহাল থাকলেও কোনও ক্ষেত্রেই তা প্রয়োগ হচ্ছে না। আইনের ৭ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনও বাড়ির ভাড়া মানসম্মত ভাড়ার অধিক বৃদ্ধি করা হইলে উক্ত অধিক ভাড়া, কোনও চুক্তিতে ভিন্নরূপ কিছু থাকা সত্ত্বেও আদায়যোগ্য হইবে না’। তবে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের শাস্তি হিসেবে অর্থদণ্ডের বিধান থাকলেও কেউ দণ্ডিত হন না।

ডিসিসির রাজস্ব বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ভাড়ার তালিকা ওয়েবসাইটে দেওয়া হলেও তা মেনে চলতে বাধ্য করার মতো আইন ডিসিসির নেই। শুধু বাড়িভাড়ার ওপর কর নেওয়া হয়।

জানা গেছে, ১৯৬৩ সালে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণে একটি অধ্যাদেশ জারি করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার। এর অধীনে ১৯৬৪ সালে প্রণীত বিধিমালাটি ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত কার্যকর ছিল। ওই সময় ৩ বছরের জন্য অধ্যাদেশটি প্রবর্তিত হয়। ১৯৯১ সালে ওই অধ্যাদেশ অনুসরণ করেই জারি হয় ‘বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৯১’।

ঢাকার জেলা প্রশাসক মুহিবুল হক বলেন, বাড়িভাড়া বৃদ্ধির কারণে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে, এর একটা সমাধান হওয়া উচিত। মানুষকে জিম্মি করে লাগামহীনভাবে ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে জনমত গঠন হওয়া দরকার। তিনি মনে করেন, পুরনো আইন দিয়ে বাড়ির মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধ করা যাবে না। আইনটি শিগগিরই যুগোপযোগী করে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। অযৌক্তিকভাবে ভাড়া বৃদ্ধির প্রবণতা বন্ধ করতে এলাকাভিত্তিক ভ্রাম্যমাণ আদালত চালুর পরামর্শ দেন তিনি।

ঠুঁটো জগন্নাথের ভূমিকায় ডিসিসি : ১৯৯১ সালের বাড়িভাড়া আইন অনুসারে ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) ৯০টি ওয়ার্ডের ১০টি কর অঞ্চলে ৭৭৩টি এলাকায় জীবনযাত্রার মান অনুসারে ভাড়ার হার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এতে পাকাবাড়ির ক্ষেত্রে সর্বনিু প্রতি বর্গফুট ৪ থেকে সর্বোচ্চ ১২ টাকা পর্যন্ত। ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে ডিসিসি আবাসিক এলাকাকে কয়েকটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছেÑ ১. প্রধান সড়কের পাশে, ২. গলির তিনশ ফুটের মধ্যে এবং ৩. গলির তিনশ ফুটের বাইরে। এছাড়া আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্পÑ এ তিন ক্যাটাগরিতেও ভাগ করা হয়েছে। হোল্ডিং নম্বর, নির্মাণের সময়কাল, কাঠামো, নির্মাণশৈলী, অবস্থান ও পজেশন হস্তান্তরের শর্তের ওপর ভিত্তি করে ভাড়ার তারতম্য হতে পারে বলেও ডিসিসির বিধানে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ডিসিসির এসব নিয়ম বাড়ির মালিকরা মানছেন না।

ডিসিসির তালিকা অনুসারে গুলশানে ১ হাজার বর্গফুটের একটি বাসার ভাড়া ১৫ হাজার টাকা, অথচ সেখানে ২৫ হাজার টাকার নিচে কোনও বাসা মেলে না। মিরপুরে ১ হাজার বর্গফুটের বাসার ভাড়া সর্বোচ্চ ৬ হাজার, সেখানে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার নিচে কোনও বাসার কথা ভাবাও যায় না। ডিসিসির অন্যান্য এলাকায় নির্ধারিত বাড়িভাড়া প্রতি বর্গফুট সর্বোচ্চÑ মতিঝিলে ১২ টাকা, বাসাবোয় সর্বনিু সাড়ে ৫ থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৬ টাকা। মাদারটেকে সর্বনিু ৫ টাকা, সর্বোচ্চ সাড়ে ৬ টাকা, গোড়ানে সর্বোচ্চ ৭ টাকা, সর্বনিু সাড়ে ৩ টাকা, সবুজবাগে সর্বোচ্চ ৬ টাকা, সর্বনিু ৫ টাকা, ফার্মগেটে সর্বনিু ৫ টাকা, সর্বোচ্চ ৭ টাকা, মগবাজারে সর্বোচ্চ সাড়ে ১১ টাকা, সর্বনিু ৯ টাকা, গুলশানে সর্বোচ্চ ১৫ টাকা, বারিধারায় সর্বোচ্চ ১৪ টাকা, ধানমণ্ডিতে সর্বোচ্চ ১৩ টাকা, সর্বনিু ৬ টাকা, মিরপুর ১২ নম্বর এলাকায় সর্বোচ্চ সাড়ে ৬ টাকা, সর্বনিু সাড়ে ৩ টাকা, খিলগাঁওয়ে সর্বোচ্চ ৭ টাকা, সর্বনিু সাড়ে ৫ টাকা, বাড্ডায় সর্বোচ্চ ৬ টাকা এবং সর্বনিু সাড়ে ৩ টাকা করে।

রাজধানীর ক্রমবর্ধমান বাড়িভাড়া এবং বাড়িওয়ালাদের ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে বিভক্ত ডিসিসির কেউ কথা বলতে চাননি। তবে তাদের এক মুখপাত্র বলেন, বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ কিংবা এ সংক্রান্ত সমস্যা নিরসনে আইন মানতে বাধ্য করার মতো কোনও ক্ষমতা ডিসিসির নেই।

ক্যাবের অভিযোগ ও পরামর্শ : ক্যাব সভাপতি কাজী ফারুখ জানান, বাড়ি ভাড়া নিয়ে হাইকোর্টে একটি রিট হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত এর সুরাহা হয়নি। ফলে সবদিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বেপরোয়া বাড়িভাড়া সমাজে অন্যায় ও দুর্নীতিকে উৎসাহিত করছে। তিনি বলেন, মূলত ডিসিসির অব্যবস্থাপনা ও নীরব ভূমিকার কারণেই রাজধানীতে কোনও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বাড়িভাড়া বেড়ে চলছে। প্রতিনিয়তই এ নিয়ে ক্যাবের কাছে অভিযোগ আসছে। এসব অভিযোগের মধ্যে রয়েছেÑ বাড়িভাড়া বৃদ্ধি, মোটা অংকের টাকা অগ্রিম জমা নেওয়া, অগ্রিমের টাকা ফেরত দিতে টালবাহানা প্রভৃতি। এসব সমাধানের জন্য বাড়িভাড়া আইনটিকে আরও যুগোপযোগী করে তা কঠোরভাবে প্রয়োগের ওপর গুরুত্ব দেন ক্যাব সভাপতি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন