সোমবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১১

যাযাবর থেকে মরুর বাদশাহ


আফ্রিকা ও আরব বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের শাসক লিবিয়ার কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফি। এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর দীর্ঘ চার দশকের বেশি সময় ধরে লিবিয়া শাসন করা গাদ্দাফির জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাপঞ্জি : লিবিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলের সিরতে ১৯৪২ সালে এক যাযাবর গোত্রে জন্ম নেন গাদ্দাফি। বেনগাজি ইউনিভার্সিটিতে ভূগোল বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করলেও মাঝপথে তা বাদ দিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন যুবক গাদ্দাফি।
১৯৬৯ : ২৭ বছর বয়সে রক্তপাতহীন এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে লিবিয়ার তত্কালীন রাজা ইদ্রিসকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন গাদ্দাফি। ভিন্নমতাবলম্বীদের কঠোরভাবে দমন করে খনিজ তেলসমৃদ্ধ লিবিয়ার দখল ধরে রাখেন তিনি। ক্ষমতা দখলের পর তিনি ইসলামঘেঁষা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ঐক্যবদ্ধ প্যান-আরব গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন। এসময় দেশের বৃহত্ প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখলেও ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যক্তিমালিকানায় রাখার অনুমতি দেন।
১৯৭৭ : দেশের নাম বদলে গ্রেট সোশ্যালিস্ট পপুলার লিবিয়ান জামাহিরিয়াহ (জনতার রাষ্ট্র) রাখেন। এসময় দেশের সাধারণ মানুষের পার্লামেন্টে তাদের মতামত জানানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তবে তার বিরুদ্ধে স্বৈরশাসন টিকিয়ে রাখার জন্য হাজার হাজার মানুষকে অবৈধভাবে মৃত্যুদণ্ড দেয়া ও বন্দি করে রাখার অভিযোগ করেছে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
১৯৭৮ : যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাম্পডেভিডে আরব বিশ্বের তত্কালীন বিবদমান দুই প্রতিপক্ষ মিসর ও ইসরাইলের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের জন্য তাদের মুখোমুখি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন গাদ্দাফি। তবে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সঙ্কট সমাধানে অত্যন্ত কঠোর দৃষ্টিভঙ্গির কারণে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন আরব দেশ তার সমালোচনা করে। এসময় থেকে তার প্যান-আরব নীতি পরিবর্তিত হয়ে প্যান-আফ্রিকা পরিকল্পনায় রূপ নেয়।
তার ঐক্যবদ্ধ আফ্রিকা গঠনের উদ্যোগই পরবর্তী সময়ে আফ্রিকান ইউনিয়নের জন্ম দেয়। তবে পশ্চিমা বিশ্বে সব সময়ই গাদ্দাফিকে সন্ত্রাসবাদী হিসেবে দেখা হয়। কলাম্বিয়ার রেভ্যুলেশনারি আর্মড ফোর্সেস অব কলাম্বিয়া (ফার্ক) এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডের আইরিশ রিপাবলিকান আর্মিকে (আইআরএ) সমর্থন দেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
১৯৮৬ : জার্মানির বার্লিনে একটি নাইট ক্লাবে বোমা হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের দুই সেনাসদস্য নিহতের ঘটনায় লিবিয়ার জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। এ সময় গাদ্দাফিকে ‘পাগলা কুকুর’ বলেও অভিহিত করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের তত্কালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান। এ ঘটনার পর ত্রিপোলি ও বেনগাজিতে যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলায় গাদ্দাফির পালিত মেয়েসহ ৩৫ লিবীয় নিহত হন।
১৯৮৮ : স্কটল্যান্ডের লকারবিতে প্যান অ্যাম এয়ারলাইন্সের একটি জাম্বো জেটবিমানে বোমা হামলায় ২৭০ জন নিহতের ঘটনায় গাদ্দাফির জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনার পরিকল্পনা করার জন্য অভিযুক্ত হন একজন লিবীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা। বহু বছর ধরে এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছিলেন গাদ্দাফি। এর ফলে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে হয় লিবিয়াকে।
২০০৩ : গাদ্দাফি প্রশাসন এ বোমা হামলার দায় স্বীকার করে নেয়। এ ঘটনায় নিহতদের স্বজনদের এক কোটি ডলার পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দিতে সম্মত হন তিনি। এছাড়া তার দখলে থাকা গণবিধ্বংসী অস্ত্রশস্ত্র ধ্বংস করার ঘোষণাও দেন এসময়। এর ফলে তার প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের কঠোর মনোভাবের পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে।
২০০৪ : যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ লিবিয়ার ওপর থেকে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। এর ফলে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে লিবিয়ার বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ায় লিবিয়ার অর্থনীতি বেশ সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। তবে ২০০৯ সালে অভিযুক্ত লিবীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরলে গাদ্দাফির পক্ষ থেকে তাকে সংবর্ধনা দেয়া হলে আবারও যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সমালোচনার মুখে পড়েন গাদ্দাফি।
২০০৯ : জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দেয়ার জন্য প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রে যান গাদ্দাফি। এ অধিবেশনে ১৫ মিনিটের বদলে দেড় ঘণ্টা ভাষণ দেন, জাতিসংঘের নীতিমালার অনুলিপি ছিঁড়ে ফেলেন এবং নিরাপত্তা পরিষদকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন আল কায়দার সঙ্গে তুলনা করেন। একইসঙ্গে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসনের ক্ষতিপূরণ হিসেবে আফ্রিকার রাষ্ট্রগুলোর জন্য ৭ লাখ ৭০ হাজার কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করেন।
২০১০ : সম্পর্কোন্নয়নের উদ্দেশ্যে ইতালি সফর করেন গাদ্দাফি। কিন্তু সফরের সময় প্রায় দুইশ’ ইতালীয় নারীকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানালে গাদ্দাফির মূল উদ্দেশ্য ঢাকা পড়ে যায়।
২০১১ : ফেব্রুয়ারিতে গাদ্দাফির শাসনের বিরুদ্ধে লিবিয়ায় গণআন্দোলন শুরু হয়। কিন্তু ওই গণআন্দোলনকে তেমন আমল না দিয়ে কঠোর হস্তে দমনের চেষ্টা চালান গাদ্দাফি। পরবর্তী সময়ে এ গণআন্দোলন গণবিদ্রোহে রূপ নেয়—যা দেশটিকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ১৭ মার্চ গাদ্দাফির অনুগত নিরাপত্তা বাহিনীর হাত থেকে বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষায় লিবিয়ায় উড্ডয়ন নিষিদ্ধ এলাকা প্রতিষ্ঠা এবং সেখানে প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ১৯ মার্চ সেখানে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু করে পশ্চিমা যৌথবাহিনী। পরবর্তীতে ন্যাটোর নেতৃত্বে হামলা চলতে থাকে।একদিকে ন্যাটোর বিমান হামলা, অন্যদিকে বিরোধী ন্যাশনাল ট্রাঞ্জিশনাল কাউন্সিলের (এনটিসি) যোদ্ধাদের হামলার মুখে গত ২২ আগস্ট রাজধানী ত্রিপোলির দখল হারান গাদ্দাফি। ২০ অক্টোবর গাদ্দাফির জন্মশহর সিরতের দখল নেয় এনটিসির যোদ্ধারা। এদিন প্রথমে তাকে আটকের খবর জানানো হলেও পরে বলা হয় নিহত হয়েছেন গাদ্দাফি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন