সোমবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১১

‘মুক্ত’ লিবিয়ার পথচলা শুরু


দীর্ঘ আট মাসের সংগ্রাম, অনেক রক্তক্ষয় এবং মুয়াম্মার গাদ্দাফির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ৪২ বছরের স্বৈরশাসন থেকে লিবিয়া মুক্ত হয়েছে। জাতীয় অন্তর্বর্তী পরিষদ (এনটিসি) গতকাল রোববার আনুষ্ঠানিকভাবে দেশ ‘মুক্ত’ ঘোষণা করেছে। এর মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের পথে লিবিয়ার পথচলা শুরু হলো।
অন্তিম শয়ানে জন্মস্থান সির্ত শহরে পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের পাশে কবরে থাকতে চান মুয়াম্মার গাদ্দাফি। এটিই ছিল তাঁর জীবনের শেষ ইচ্ছা। একটি উইলে এমনই আকাঙ্ক্ষার কথা জানিয়েছিলেন লিবিয়ার এই নেতা। এনটিসি কর্তৃপক্ষও জানিয়েছে, তাঁর লাশ আত্মীয়দের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তবে কোথায় লাশ দাফন করা হবে, সেটা নিয়ে তাঁদের সঙ্গে আগে আলোচনা হবে।
লিবিয়া ‘মুক্ত’ ঘোষণার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় পূর্বাঞ্চলীয় বেনগাজি শহরে। গত ফেব্রুয়ারিতে গাদ্দাফিবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম শুরুর পরপরই প্রথম দিকে বেনগাজি শহর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় বিদ্রোহীরা। এরপর নিজেরা সংগঠিত হয়ে গঠন করে এনটিসি। আট মাস ধরে এনটিসি যুদ্ধ ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড বেনগাজি থেকেই পরিচালনা করছে।
অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় একটি সেনা ব্যারাকের বাইরে, যেখানে গত ফেব্রুয়ারিতে গাদ্দাফির সেনাদের মুখোমুখি হয়েছিল আন্দোলনকারীরা। অনুষ্ঠানে প্রায় ১০ হাজার মানুষ জড়ো হয়। জাতীয় সংগীত গেয়ে, তিন রঙা পতাকা উড়িয়ে এবং গজলের মাধ্যমে সশস্ত্র সংগ্রামে নিহত ব্যক্তিদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয় অনুষ্ঠানে।
অনুষ্ঠানে এনটিসির উপপ্রধান আবদেল হাফিজ ঘোগা বলেন, ‘লিবিয়া মুক্ত হয়েছে। আপনারা মাথা উঁচু করে দাঁড়ান। এখন আপনারা মুক্ত।’ অনুষ্ঠানে এনটিসির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সারা বিশ্বের কাছে আমরা ঘোষণা দিচ্ছি, প্রতিটি শহর, গ্রাম, পর্বতচূড়া, গভীর মরুভূমি ও আকাশসহ আমরা আমাদের প্রিয় দেশকে মুক্ত করেছি।’
এনটিসি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, এক মাসের মধ্যে একটি অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে। এরপর আট মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে সাংবিধানিক পরিষদের নির্বাচন। এক বছরের মধ্যে পার্লামেন্ট ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে।
এর আগে এনটিসির মুখপাত্র মুস্তাফা গোবরানি বলেন, রোববারের এই সমাবেশের মধ্য দিয়ে লিবিয়ায় নতুন দিনের সূচনা হলো। তিনি বলেন, ‘এই প্রথম আমরা অনুভব করছি, আমরা পূর্ণ স্বাধীন। স্বৈরশাসকের হাত থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি, আমাদের গণতান্ত্রিক পথচলা শুরু হলো।’
গত আগস্টে ত্রিপোলির পতন হয়। এর পর থেকে সির্ত শহরই ছিল গাদ্দাফি অনুগত বাহিনীর সবচেয়ে বড় ঘাঁটি। ত্রিপোলির পতনের পর এনটিসি ঘোষণা দিয়েছিল, সির্ত শহর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারলে দেশ মুক্ত বলে ঘোষণা করবে। গত বৃহস্পতিবার সির্তের নিয়ন্ত্রণ পেয়েছে এনটিসি। একই দিনে এনটিসি যোদ্ধাদের হাতে নিহত হন গাদ্দাফি।
ময়নাতদন্ত: লিবিয়ার প্রধান প্যাথোলজিস্ট ওসমান আল-জিনতানি গতকাল জানান, গাদ্দাফির মরদেহের ময়নাতদন্ত হয়েছে। এতে জানা গেছে, মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
লাশ হস্তান্তর: অন্তর্বর্তী সরকারের একজন জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা গতকাল জানান, গাদ্দাফিকে কোথায় দাফন করা হবে, সে বিষয়ে তাঁর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আলোচনার পর লাশ তাঁদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ জিবরিলের উপদেষ্টা আহমেদ জিবরিল বলেন, ‘গাদ্দাফির পরিবারের কোনো সদস্য এই মুহূর্তে লিবিয়ায় নেই। তবে তাঁর আত্মীয়দের কাছে লাশ হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
আহমেদ জিবরিল আরও বলেন, ‘এনটিসি গাদ্দাফির পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করছে। এনটিসির সঙ্গে পরামর্শ করে তাঁরাই লাশ দাফনের স্থান নির্ধারণ করবেন।’
গাদ্দাফির লাশ মিসরাতা শহরের একটি হিমঘরে রয়েছে। লাশ দাফন নিয়ে প্রথম দুই দিন এনটিসি কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়ায় গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল, লাশ হয়তো কোনো অজ্ঞাত স্থানে দাফন করা হতে পারে।
গাদ্দাফির শেষ ইচ্ছা: গাদ্দাফি জন্মস্থান সির্ত শহরে পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের পাশে নিজের কবর দেওয়ার জন্য শেষ ইচ্ছার কথা জানিয়ে গেছেন এক উইলে। গতকাল গাদ্দাফির নিজস্ব ওয়েবসাইট সেভেন ডে নিউজ-এ এই ইচ্ছার কথা প্রকাশ করা হয়েছে।
ওয়েবসাইটে বলা হয়, এ উইল বা ইচ্ছাপত্র তাঁর তিন আত্মীয়ের কাছে দিয়ে গেছেন। তাঁদের মধ্যে একজন নিহত হয়েছেন। দ্বিতীয়জন গ্রেপ্তার ও তৃতীয়জন সির্তে লড়াইয়ের সময় পালিয়ে গেছেন।
উইলে গাদ্দাফি তাঁর সমর্থকদের বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। তিনি লিবিয়ার জন্য যুদ্ধ করে দেশেই মরতে চেয়েছেন। যুদ্ধের সময় তিনি বিদেশে চলে যাওয়ার অনেক প্রস্তাব নাকচ করে দেন।
উইলে বলা হয়, ‘আমি মুয়াম্মার গাদ্দাফি, মুসলমান হিসেবে মরতে চাই। যদি আমাকে হত্যা করা হয়, তবে আমাকে যেন মুসলমান রীতিতে কবর দেওয়া হয়। মারা যাওয়ার সময় আমার শরীরে থাকা পোশাক এবং আমার লাশ যেন পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। আর আমাকে যেন সির্ত শহরেই দাফন করা হয়।’
গাদ্দাফিকে জীবিত চেয়েছিলেন জিবরিল: প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ জিবরিল বলেন, তিনি গাদ্দাফিকে জীবিত আটক করতে চেয়েছিলেন। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কি, আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে চেয়েছিলাম, তাঁকে জীবিত আটক করা হোক। জীবিত গাদ্দাফির কাছে আমি জানতে চাইতাম, ৪২ বছর ধরে তিনি কেন লিবিয়ার মানুষের ওপর এমন নির্যাতন চালালেন। তাঁর বিচারে আমি বাদী হতাম।’
তবে গাদ্দাফির হত্যার ঘটনা তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া হলে স্বাগত জানাবেন বলে জানান জিবরিল। এএফপি, রয়টার্স ও বিবিসি অনলাইন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন