শনিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১১

উৎপাদনের উপায়ের মালিক হতে মুক্তিআন্দোলনের প্রতীকি কর্মসূচি

মুক্তিআন্দোলন একটি পাঠচক্র। গণতান্ত্রিক চেতনা বিকাশে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক তৎপরতার পাঠচক্র, একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। মুক্তিআন্দোলন পাঠ করে আল্লাহর নিদর্শনসমূহ। গবেষণা করে বাংলার মাটি, মানুষ, মানুষের ভাব, স্বভাব, আচার, আচরণ, বিশ্বাস, অবিশ্বাস, ভালোলাগা, মন্দলাগা ও তার সংস্কৃতি তথা- বাংলার মানুষের প্রকৃতি। কেননা, মুক্তিআন্দোলন বর্তমান এই প্রচলিত বে-ইনসাফি ব্যবস্থাকে গ্রহণ করতে পারে না। এই বেদনাদায়ক সমাজ বাস্তবতার পরিবর্তন চায়।
মুক্তআন্দোলন মনে করে, অভাবী মানুষ মাত্রই পরাধীন। যে মানুষের ঘরে অভাব রয়েছে সে কখনই স্বাধীন হতে পারে না। তাই পরাধীনতা থেকে মুক্তির উপায় হলো অভাবমুক্ত হওয়া। এই অভাবমুক্তির ব্যাপারে বাংলাদেশে নানা প্রতিষ্ঠান নানা রকমের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। রাষ্ট্রও নানা সময়ে নানা পদক্ষেপ একের পর এক গ্রহণ করে চলেছে। মানুষের এই অভাবকে সামনে রেখেই ইতোমধ্যে নানা দুর্বৃত্ত, নানারকম কর্মসূচি নিয়ে মানুষের সামনে হাজিরও হচ্ছে। দীর্ঘকাল ধরে মানুষ তাদের দ্বারা প্রতারিত হচ্ছে, বঞ্চিত হচ্ছে, কিন্তু অভাব মোচন হচ্ছে না। মুক্তিআন্দোলন মনে করে, প্রতিটি মানুষকে উৎপাদনের উপায়ের মালিক হতে হবে। প্রতিটি মানুষের সাথে তার উৎপাদিত ফসলের সম্পর্ক হতে হবে মালিকানার। মানুষ যখন বিদ্যমান উৎপাদন-উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটাবে, সম্পর্ক প্রতিস্থাপন করবে মালিকানার, সেদিনই প্রকৃত অর্থে মানুষের অভাবের অবসান ঘটবে। বাংলাদেশে শুধু না, বিশ্বব্যাপী এই অর্থনৈতিক অভাবমোচনের প্রশ্নে খাদ্য নিরাপত্তার নামে আজকে নানা রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে- টাকা থাকলেই খাদ্যের নিশ্চয়তা হবে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। কিন্তু মুক্তিআন্দোলন তা মনে করে না। বরং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার পূর্ব শর্ত হচ্ছে- কৃষিতে খাদ্য সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত থাকা। খাদ্য সার্বভৌমত্ব অর্থ হলো- এই পৃথিবীর মাটিতে যেখানে যে ফসলের জন্ম হয়েছে অর্থাৎ সেইঅনাদিকাল থেকে যেখানের যে মাটিতে যে ফসলের জন্ম হয়েছে সেই মাটির সাথে সেখানকার ফসলের আর উৎপাদকের সম্পর্কের কখনও ছেদ ঘটানো যাবে না। কিন্তু আজ আমরা লক্ষ্য করছি, শুধুমাত্র খাদ্য নিরাপত্তার নামে অর্থকেই (টাকা) বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে এবং অর্থ আয়ের জন্য মাটির সাথে তার কৃষির সম্পর্কের ছেদ ঘটানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, টাকা থাকলেই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। যেমন সমাজে প্রচলিত আছে- ‘টাকা থাকলে বাঘের চোখ মেলে’। সেকারণে আমরা লক্ষ্য করছি, যে মাটিতে হাজার হাজার বছর ধরে ধান রোপন হয়েছে, সে মাটিতে আজ অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অজুহাতে চাষ করা হচ্ছে তামাক, ভূট্টা, ফুল ইত্যাদি। আমরা মনে করি এতে হয়তোবা অর্থ আসবে, কিন্তু খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না। কেননা, মানুষ তো খাদ্য খায়। যখনই সে তার জমিতে একের পর এক অর্থ উপার্জনের জন্য খাদ্য উৎপাদন ব্যতিরেকে তামাক, ভুট্টা, ফুল লাগাবে, তখনই সে খাদ্য থেকে বঞ্চিত হবে। এই খাদ্য তখন তাকে টাকা দিয়ে কিনতে হবে বহুজাতিক কোম্পানীর কাছ থেকে। খাদ্য আসবে বাইরে থেকে। আর এই বহির্শক্তি যখন জানতে পারবে যে, এই দেশে আর খাদ্য উৎপাদন করা সম্ভব নয় কেননা এ দেশ খাদ্য উৎপাদনের উপকরণ হারিয়ে ফেলেছে, হারিয়ে ফেলেছে তারা তাদের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, তখন খাদ্যের দাম কোম্পানী ইচ্ছামত বাড়াবে। পকেটের টাকা দিয়ে সেই খাদ্য কেনা আর সম্ভব হবে না।
আমরা মনে করি এই খাদ্য নিয়ে আজ বিশ্বব্যাপী রাজনীতি হচ্ছে। খাদ্য এখন রাজনীতির বড় হাতিয়ার। আর এই রাজনীতি থেকে মুক্ত হতে হলে আমাদের কৃষিতে খাদ্য সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত থাকতে হবে। আমাদের প্রতিটি নাগরিককে উৎপাদনের উপায়ের মালিক হতে হবে। উৎপাদনের উপায়ের মালিক হতে হলে দরকার পুঁজি। আর ঠিক এই মুহূর্তে আমাদের দেশে দারিদ্র্য বিমোচনের নামে ক্রিয়াশীল রয়েছে নানা কর্মসূচী, যেমন- ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প। মুক্তিআন্দোলন পাঠচক্র অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে এই উপলব্ধিতে পৌছেছে যে, এখনও পর্যন্ত ১৬ কোটি মানুষের পক্ষে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকা কোনো ঘটনাই না। এ দেশের মানুষের মধ্যে এখনও মানুষের প্রতি যে ভালোবাসা, দায়বোধ জীবন্ত আছে সে ভালোবাসা ও দায়বোধকে যদি আমরা জাগিয়ে তুলতে পারি। এটা জেগেই আছে, আমরা যদি তা কাজে লাগাতে পারি। এদেশের মানুষের নৈতিকতা, মূল্যবোধ তথা ধর্মীয় মূল্যবোধকে যদি আমরা কাজে লাগাতে পারি।
ধর্মের বহু জায়গায় স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে, মানুষকে দান করার কথা Ñ যাকাত, ফিতরা ছাড়াও আকীকা, চল্লিশা, কুরবানী বিভিন্ন প্রকার উৎসর্গ তথা আল্লাহর রাস্তায় দান মুসলমানদের শিক্ষায় আছে। এ সমস্ত দানের মহিমা যদি আমরা বুঝি এবং খুবই পরিকল্পিতভাবে যদি সেই দান সংগ্রহ করি এবং সেই সংগ্রহ পরিকল্পিত উপায়ে কাজে লাগাতে পারি, মুক্তিআন্দোলনের বিশ্বাস- এ দেশের মানুষকে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার  জন্য কোনোদিকে তাকাতে হবে না। কারো কাছে হাত পাততে হবে না। মুক্তিআন্দোলন সে লক্ষ্যে কিছুদিন ধরে দানের অর্থ সংগ্রহ করেছে। ইতোমধ্যে প্রায় ১ লক্ষ টাকা সংগ্রহ হয়েছে। মুক্তিআন্দোলন সেই সংগৃহিত অর্থ পরিকল্পনা মাফিক দু’টি গ্রামকে বেছে নিয়ে সেখানে ৫২টি পরিবারের মধ্যে ৫৪টি হেলন ছাগল বা বকরি প্রদান করবে। গ্রাম দু’টি হলো- যশোর সদরের আরবপুর ইউনিয়নের সুজলপুর ও পাকদিয়া। এই ৫২টি পরিবার মুক্তিআন্দোলনের সাথে একটি ‘হলফনামা’-য় অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে যে, এই দানের ছাগল তারা জবাই বা বিক্রি করতে পারবে না। কিন্তু ছাগলটি লালন পালন করলে জীবনে যত পত্তন দেবে সবই মালিক হিসেবে সেই ভোগ করবে। এবং এই পত্তনের মধ্য থেকে দ্বিতীয় পত্তনের একটি মাত্র হেলন বা বকরি সে পুনরায় মুক্তিআন্দোলনে দান করবে। যা মুক্তিআন্দোলন অন্য কোনো গ্রামের গরীব মানুষের মধ্যে দান করবে। একই সাথে ঐ পরিবারগুলি তার বাড়ির আঙ্গিনায় একটি দেশী কাঁঠাল গাছ এবং একটি দেশী আমগাছ রোপন করতে বাধ্য থাকবে। জাতীয় ফল কাঁঠাল এবং জাতীয় গাছ আম রোপনের মধ্য দিয়ে মুক্তিআন্দোলন মানুষের ফলের চাহিদা, ছাগলের খাদ্য এবং পরিবেশে পাখি ফিরিয়ে আনবে।
মুক্তিআন্দোলন নিয়মিত দেখ-ভালের মধ্যে দিয়ে এই ছাগলগুলির মধ্য থেকে হয়তো ৩টি খাসি বিক্রয় করে একটি গরু ক্রয়ের পরামর্শ দেবে। এভাবে পরিবারগুলির ভিতরে হাঁস, মুরগী, কবুতর ইত্যাদি লালনের অভ্যাস গড়ে তুলবে। একই ভাবে প্রতিটি পরিবার নিজেই নিজের খাদ্যের অভাব পূরণ করবে। মুক্তিআন্দোলন এই গ্রাম দু’টিতে এভাবে দুই বছর কার্যক্রম অব্যাহত রেখে পর্যবেক্ষণ করবে যে, মানুষ তার ছাগলের পত্তন থেকে একটি ছাগল দান করে কি না, সে আম, কাঁঠাল গাছ লাগায় কি না, সে ছাগল বিক্রয় বা জবাই করছে কি না, ছাগলটি মারা যাচ্ছে বা অসুখ বিসুখে ভুগছে কি না ইত্যাদি। এই পর্যবেক্ষণ শেষে আমরা দেখতে পাবো আমাদের উদ্দেশ্য কতটুকু সফল হয়। এভাবেই আমরা দু’বছরের মাথায় যেয়ে এখান থেকে হয়তো একটি তত্ত্ব নির্মাণ করতে পারবো- আমরা নিজেরা কিভাবে উৎপাদনের উপায়ের মালিক বনতে পারি।
মুক্তিআন্দোলনের বিশ্বাস অবশ্যই এদেশের মানুষ এই প্রয়াসকে সহযোগিতা করবে। আমরা প্রতি বছর ১৭ই ডিসেম্বরকে এই কার্যক্রমের দিন হিসেবে বেছে নিয়েছি। আমাদের দর্শন হলো- ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস। বিজয়ের উল্লাসে আমরা মেতে ছিলাম। আজ ১৭ই ডিসেম্বর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে এখনি শুরু করতে হবে সমাজ ও দেশ গঠনের কাজ। আমাদের বিশ্বাস আপনারা আমাদের সাথে থাকবেন এবং অবশ্যই আমরা কামিয়াব হবো। 
৩ ডিসেম্বর-২০১০

বেনজীন খান
মুখপাত্র
মুক্তিআন্দোলন বাংলাদেশ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন