মঙ্গলবার, ২০ জুন, ২০১৭

মোদির রাজনীতি, গরু নিষেধাজ্ঞা

হিন্দুত্বের ভিত্তিতে গড়া ও দাঁড়ানো এক রাষ্ট্র হল ভারত। এই রাষ্ট্র গঠনের সময় মনে করে করা হয়েছিল যে, বিভিন্ন প্রাদেশিক বৈশিষ্টে বিভক্ত রাজ্যের (এখন ২৯ রাজ্যে বিভক্ত) ভারতকে ‘হিন্দুত্ব’ এই আঠা না থাকলে একে এক রাখার আর কোনো উপায় নেই; এই ধারণাটা ভুল যদিও। ভারতের উগ্র হিন্দুসমাজ মুসলমানসমাজকে নিজের অধীনে আনা ও চাপে রাখার জন্য কী না করতে পারে, সাম্প্রতিক ঘটনাবলি এরই আদর্শ নমুনা। ভারতে গরুর (মহিষ উট গবাদিসহ সব পশু) গোশত খাওয়া নিষিদ্ধ। [The notification covers bulls, bullocks, cows, buffaloes, steers, heifers and calves, as well as the camel trade.] মানে, বেচাবিক্রি, জবাই ও খাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এর আসল উদ্দেশ্য হল, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবের দিক থেকে আধিপত্যে থাকা সংখ্যাগুরু কমিউনিটির পছন্দসই বিধিব্যবস্থার অধীনে মুসলমান কমিউনিটিকে আনা, দাবড়ানো। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা সরাসরি নয়, জারি করা হয়েছে এক অদ্ভুত কায়দায়। কংগ্রেসের নেহরু আমলে তারা এর প্রথম কায়দাটা বের করেছিলেন। তা হল ভারতীয় রাষ্ট্র “পশু-প্রেমী” হয়ে গিয়েছিল। তারা ‘প্রিভেনশন অব ক্রুয়েলিটি টু অ্যানিমেল অ্যাক্ট ১৯৬০’ নামে এক আইন পাস করে ফেলেছিলেন। শুধু তাই নয়, এই আইন বাস্তবায়নের জন্য ‘সোসাইটি ফর প্রিভেনশন অব ক্রুয়েলিটি টু অ্যানিমেলস’ নামে সমিতি গড়ার ব্যবস্থাও করেছিলেন। মুল কথা ছিল, “পশুকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যথা বা কষ্ট দেয়ার মতো নিষ্ঠুরতা করা যাবে না” এর ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে এই আইনটা লেখা হয়েছিল। আইনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সব জায়গায় একই কথা বলা হয়েছিল যে, ‘পশুকে অপ্রয়োজনীয় ব্যথা ও কষ্ট দেয়া রোধ’ করাই উদ্দেশ্য।
আইনটি কেমন তা বোঝার সবচেয়ে ভালো এক উপায় হল, এতে ব্যবহৃত কয়েকটি শব্দ লক্ষ করতে হবে। যেমন ‘পশুর কল্যাণ, ‘পশুর ব্যথা’, ‘পশুর কষ্ট’, ‘পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা’ ইত্যাদি। অর্থাৎ বোধ বা অনুভূতিগুলো (ফলে শব্দগুলো) আসলে মানুষের, মানুষ সম্পর্কিত। কিন্তু সেগুলোকে অবলীলায় পশুর ওপর প্রয়োগ করে ধারণাগুলো তৈরি করা হয়েছে। আর এখানে সবচেয়ে তামাশার শব্দ হল, ‘পশুর কল্যাণ বা ওয়েলফেয়ার’। বিগত ১৯৬০ সালের ভারতে তো বটেই, এখনকার ভারতেও কোনো কোনো আম-মানুষের অবস্থা এমন যে, পশুর ওপর তো বটেই, আপন সন্তান বা স্ত্রীসহ পরিবারের আপন সদস্যদের ওপর “ব্যথা, কষ্ট বা নিষ্ঠুরতা” দেখানো ছাড়া নিজের পেটের ভাত জোগাড়ের আর কোনো উপায় থাকে না। অথচ সেই দেশে মানুষের বদলে পশুর ওয়েলফেয়ার নিয়ে আইন করা হয়েছিল, চিন্তা করতে বলা হয়েছিল। আসলে আইনটি করেছিল অবস্থাপন্ন শ্রেণী। করেছিল মুসলমান কমিউনিটিকে হেয় করে দেখাতে যে, তারা ‘ব্যথা ও কষ্ট দিয়ে বা নিষ্ঠুরতা করে’ গরুর গোশত খায়। অতএব এটা বন্ধ করতে হবে। এক কথায় একটা ধর্মবিদ্বেষ বা ইসলামবিদ্বেষ তৈরি করার জন্য এটা করা হয়েছিল। তবে অবশ্য এটা ছিল এক ইনডাইরেক্ট ফ্রি-কিক, এক পরোক্ষ আইন। কারণ এই আইনের সেকশন ২৮-এ এক ফাঁকে একটা ছাড় দেয়া ছিল। [Section 28 of the Act 1960, mandates that “nothing contained in this Act (1960 Act) shall render it an offence to kill any animal in a manner required by the religion of any community.”]। বাংলা করলে বলা হয়েছিল, “কোনো কমিউনিটির ধর্মীয় আচার হিসেবে বিধান মতে যদি জবাই করা হয়, পশুকে ব্যথা, কষ্ট বা নিষ্ঠুরতা দেখানো হয়, তবুও সে ক্ষেত্রে এই আইন প্রযোজ্য হবে না”।
কিন্তু গত ১৯৬০ সালের সেই আইনের ওপরে এবং সেই আইনের সীমার মধ্যে থেকে নতুন করে দু’টি বিধি তৈরি করেছে মোদি সরকার। এর একটা হল,
Prevention of Cruelty to Animals (Care and Maintenance of Case Property Animals) Rules, 2017

সোজা বাংলায় বললে, প্রথমটা মুল অর্থ হল, পশুর হাট বা মার্কেট ভেঙে দেয়া। অর্থাৎ জবাই করার উদ্দেশ্যে মার্কেটে থেকে কোন পশু কেনা অথবা বেচা যাবে না- এরই আইন এটা। কারণ দেখা গেছে, প্রায় ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে জবাইয়ের গরুটা হাট/মার্কেট হয়ে আসে। তাই প্রথম আইনটার ২২ (৩) ধারায় বলা হয়েছে “জবাইয়ের উদ্দেশ্যে বিক্রির জন্য কোনো পশু কোনো মার্কেটে তোলা, কেনাবেচা করা যাবে না’। [22 (iii) stating that the cattle has not been brought to market for sale for slaughter;] আর সাথে এই কথাটাই হাটে যে কোন গরু উঠানোর পর  ‘রেজিস্ট্রেশন করাতে হবে আর সেখানে শপথ করে বলতে হবে” ইত্যাদি তো আছেই। আর দ্বিতীয় আইন হলটা হল কেয়ার মেন্টেনেন্স না করলে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে সেসব সংক্রান্ত।
হাটে পশু উঠবে, রেজিস্ট্রেশন হবে, কানে রেজিস্ট্রেশন নাম্বার লাগবে, কেনাবেচা হবে; তবে তা কেবল পশু কৃষিকাজের ব্যবহারের উদ্দেশ্য। গরুর ক্রেতা ও বিক্রেতা এই লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়েই কেবল হাটে গরু বেচা ও ক্রয় করতে পারবে।  তাহলে মূল কথাটা হল,  গরুর গোশতের জন্য গরু কেনাবেচা করা যাবে না। এমনকি পশু মারা গেলে বা পশু অসুস্থ হয়ে মরা অথবা আয়ু শেষে মরা যা-ই হোক, সব ক্ষেত্রেই মরা গরু একেবারে সোজা মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। কোন ভাবেই মরা গরুর বা মারা গরুর চামড়া ছিলানো যাবে না। অথবা মারা বা কাটা গরুর হাড়গোড়সহ কোনো অবশেষই সংগ্রহ ও বিক্রি করা যাবে না। চামড়াও বিক্রি করা যাবে না।
এই হলো মোটা দাগে আইনটি সম্পর্কে ধারণা দেয়া যেখানে দেখা যাচ্ছে শুরু থেকেই এই আইনের উদ্দেশ্য প্রশ্নবোধক। ফলে কথাটা এভাবে বলা যায়, “পশুর উপর নিষ্ঠুরতা ঠেকানোর” নামে কংগ্রেস আমলেই মুসলমানের প্রতি বৈষম্যটা করা হয়েছিল, কিন্তু দুর্বলভাবে। আর সেটাকেই এখন সবলভাবে করতে চাইছেন বিজেপি-আরএসএসের নেতা মোদি। গত ২৩ মে গেজেটেড বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এই নতুন আইন সম্পর্কে মোদি সরকার সবাইকে “নোটিফাই করে” জানিয়েছে। আর এই আইন জারি করে তা সেই পুরনো আইনের ওপর দাঁড় করানো বলে এটা কংগ্রেসকেও বেকায়দায় ফেলতে পেরেছে, যাতে কংগ্রেস মোদির সমালোচনা করতে গিয়ে থেমে যায়। কারণ তাতে ১৯৬০ সালের নেহরুকেই সমালোচনা করা হয়ে যায়। আবার ‘পশুর ওপর নিষ্ঠুরতা ঠেকানো’র নামে এবার সবলভাবে ইসলামবিদ্বেষটা মোদি সফলভাবে দেখাতে পারেন। তবে আরো কারণও আছে।
একটা কথা পরিস্কার রাখা দরকার। এতদিন গরু জবাই দেয়া, বেচাকেনা ও খাওয়া সম্পর্কে যেসব খবর আমরা শুনে আসছিলাম তা কেন্দ্রীয় বা মোদি সরকারের কোনো আইন ছিল না। এমনকি ২০১৫ সালে মোদির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং বাংলাদেশের সীমান্তে এসে বিএসএফকে ‘বাংলাদেশের গরু খাওয়া বন্ধ করা’র যে তাতানো বক্তব্য দিয়েছিলেন সেটাও আসলে মন্ত্রীর অনধিকারচর্চা ছিল। কারণ গরু জবাই বন্ধ করা কেন্দ্রের বা রাজনাথদের মন্ত্রিসভার কোনো সিদ্ধান্ত বা আইন ছিল না, আবার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারেরও কোনো আইন ছিল না সেটা। তবে দুই বছর আগে মহারাষ্ট্র রাজ্য সরকারে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর সেখানে এ আইন পাস করা হয়েছিল। আর তা সবচেয়ে বেশি প্রচার পেয়েছিল বা বিজেপি প্রচার করেছিল। এজন্য এটা যে কোন কেন্দ্রিয় মন্ত্রীর জন্য অনধিকার ছিল।  তবে এবার প্রথম কেন্দ্র নিজেই আইন জারি করা হলো। কিন্তু এতে বিভিন্ন অ-বিজেপি রাজ্যসহ বিভিন্ন বিজেপি-শাসিত রাজ্য থেকেও বিরোধিতা প্রবল হয়ে উঠেছে। কৃষিকাজ সংশ্লিষ্ট এই বিষয় ‘রাজ্যসরকারের এখতিয়ার’ এমন দাবি বা এই প্রশ্ন উঠিয়েছে কেরালা ও পশ্চিমবঙ্গ। কথা সত্য ইস্যুটায় রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্ত নিবার এক্তিয়ার।  মমতা ব্যানার্জি এই আইনকে কঠোর সমালোচনা করে বক্তব্য রাখেন।অন্যান্য রাজ্যকেও তারা আপত্তি তোলার আহ্বান রেখেছিলেন। শেষে গত ২ জুন ‘মোদির সেনাপতি’ অরুণ জেটলি বলেন, ‘নতুন বিজ্ঞপ্তি রাজ্যসরকারের এখতিয়ারে হস্তক্ষেপ নয়।’ দৈনিক আনন্দবাজার এই কথার অর্থ করেছে, ‘গবাদিপশু জবাইয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার রাজ্যের হাতেই থাকছে’। মোদির খাস লোক তার অর্থমন্ত্রী জেটলির মন্তব্যের একটা ব্যাখ্যা আনন্দবাজার হাজির করে বলছে, ‘এখন কেন্দ্রের পক্ষ থেকে যে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে, তাতে রাজ্যের আইনে হস্তক্ষেপ হচ্ছে না। এটি শুধু গবাদিপশুর কেনাবেচার স্থানসংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি। কৃষকেরা গবাদিপশু শুধু বাজারে বেচতে পারবেন নাকি বাজারের বাইরে থেকেও কেনা যাবে, বিজ্ঞপ্তি শুধু সেটি নিয়েই। কিন্তু তাদের জবাই করার জন্য রাজ্যের আইনই বলবৎ থাকবে”।
কিন্তু আইনগত দিক থেকে মোদির এই আইন কি আদালতে টিকবে, নাকি কনস্টিটিউশনের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করেছে বলে বাতিল হয়ে যাবে? গুজরাটের হাইকোর্টের (ময়ূর) বিচারপতি গোমূত্র পানে ও প্রশংসায় বেহুঁশ, তা আমরা জেনেছি। কিন্তু শক্ত তর্ক উঠেছে দক্ষিণে তামিলনাড়–তে মাদ্রাজ হাইকোর্টের মাদুরাই বেঞ্চে। সেখানকার রিট পিটিশনের পয়েন্ট খুবই শক্তিশালী। যেমন তারা বলছেন, “নতুন আইনটা প্যারেন্ট আইনের বাইরে যেতে পারে না”। ১৯৬০ সালের আইনে যেকোনো কমিউনিটির ধর্মীয় শরিয়ত বা রিচুয়াল হিসেবে পশু কেনাবেচা, কোরবানি এবং গোশত খাওয়ার ওপরে এই আইন প্রযোজ্য করা হয় নাই, বাইরে ছাড় দিয়ে রাখা হয়েছিল। কাজেই এখনও কেন্দ্রের কোনো এখতিয়ার নেই সেটা লঙ্ঘন করার। এ ছাড়া ভারতীয় কনস্টিটিউশনে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারবিষয়ক ২৫ ধারায় ‘অবাধে ধর্মপালন নাগরিকের অধিকার’ এবং ২৯ ধারায় ‘সংখ্যালঘুর স্বার্থরক্ষা’ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এই দুই অধিকারই মোদির নতুন আইনে লঙ্ঘন করা হয়েছে। এ ছাড়া আর একটা পয়েন্ট আনা হয়েছে তা হলো, ভারতীয় কনস্টিটিউশনের অনুচ্ছেদ ১৯ (১)(জি) অনুসারে কোনো পেশার লোককে বেকার করে দেয়া যাবে না। এখানে কসাইসহ চামড়া ইত্যাদির প্রক্রিয়াজাত করা যাদের পেশা তাদেরকে কাজ-পেশাহীন করে দেয়া হয়েছে। ফলে এটাও অভিযোগের একটি জোরালো যুক্তি।
ওদিকে ভারতের সুপ্রিম কোর্টেও একটা জনস্বার্থ বা পাবলিক লিটিগেশনের মামলা হয়েছে।সেখানেও উপরের পয়েন্টগুলো ছাড়াও একটা বাড়তি পয়েন্ট হল, পুরনো আইনের ১১ অনুচ্ছেদ। সেখানে গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্যে পশু জবাইকে খাদ্য জোগাড় হিসেবে দেখা হয়েছিল, নিষ্ঠুরতা হিসেবে দেখা হয়নি। তবে সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছিল যে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত কষ্ট দেয়া ও নিষ্ঠুরতা না করা সাপেক্ষে তা করতে হবে। তাই এবার সুপ্রিম কোর্ট আগামী ১১ জুলাই শুনানির দিন ধার্য করেছেন আর সরকারকে জবাব তৈরি করে আসতে বলেছেন। এই মামলার বাদি হলো হায়দরাবাদের এক এনজিও, বাদির দাবি- মোদির দুই নতুন আইন অসাংবিধানিক ঘোষণা করে তা বাতিল করে দিতে হবে।

তবে আগেই বলেছিলাম মোদির আইনে ‘পশুর ওয়েলফেয়ার’ কথাটার সত্যিই বিষ্ময়কর। এক ধরনের ওয়েলফেয়ার সংগঠনের কথা আইনে অনেকবার রেফার করা হয়েছে। আর এটাই হল, বিজেপি- আরএসএসের লোকাল ‘পশুর ওয়েলফেয়ার কমিটি’ যাদের হাতে পশু ব্যবসায়ীরা নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, এরা আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে এবং তারা পাবলিক লিঞ্চিং বা প্রকাশ্যে হত্যার ঘটনাও ঘটাচ্ছে। আশা করা যায়, এ বিষয়গুলোও আদালত আমলে নেবে। সব মিলিয়ে বলা যায়, মোদির আইন দু’টি আদালতে চ্যালেঞ্জ হয়ে বাতিল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যদি তা হয়, তবে এটা ভারত রাষ্ট্রকে বাড়তি কিছু আয়ু দেবে।

বৃহস্পতিবার, ১৫ জুন, ২০১৭

আন্তর্জাতিক আইনে সই করুন, গঙ্গা ব্যারাজ বাতিল নয়

গত এপ্রিলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দিনের সফরে নয়াদিল্লি যান। সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে যেসব সমঝোতা ও চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে, দেশে ফিরে গণভবনে এর বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তিনি এক সংবাদ সম্মেলন করেন। ওই সংবাদ সম্মেলনে তিনি দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান আন্তসীমান্ত নদীগুলোর পানি ভাগাভাগির কথাও বলেছেন। বিশেষ করে তিস্তার পানি চুক্তি না হওয়ায় বাংলাদেশে যে হতাশার সৃষ্টি হয়েছে, সে কথাও সংবাদ সম্মেলনে উঠে এসেছে। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। তারপরও বিষয়টি নিয়ে অনেক অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। বিশেষ করে তিস্তা ব্যারাজের একজন ভূতপূর্ব প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে এ বিষয়ে আমার যে অভিজ্ঞতা এবং দেশের একজন পানি প্রকৌশলী হিসেবে আমার যে উপলব্ধি, তা এখানে উল্লেখ করতে চাই।

তবে আমার উপলব্ধি প্রকাশের আগে গত ১৮ মে প্রথম আলো তিস্তা সম্বন্ধে চার পৃষ্ঠার অত্যন্ত সময়োপযোগী ও চমৎকার যে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে, তা নিয়ে দু-একটা কথা বলি। তিস্তার পানি যে প্রত্যাহার করে মহানন্দায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং ভারত যে তা করতে পারে না—এমন তথ্য আমি সেখানে প্রত্যাশা করেছিলাম। এমনও হতে পারে, আমাদের দেশের পানি বিশেষজ্ঞরাও হয়তো এ বিষয়ে খবর রাখেন না।

তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। এই নদী হিমালয় থেকে উৎপন্ন হয়ে ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্য দিয়ে ২৪৯ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের লালমনিরহাট জেলার দহগ্রামে প্রবেশ করে ১১৭ কিলোমিটার পথ প্রবাহিত হয়ে তিস্তামুখ ঘাটের কাছে ব্রহ্মপুত্র নদে পড়েছে। জাতিসংঘের ১৯৯৭ সালের ‘কনভেনশন অন দ্য ল অব দ্য নন-নেভিগেশনাল ইউজেস অব ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার কোর্সেস’ (Convention on the law of the non-navigational uses of International Water Courses) ২০১৪ সালে ৪০টি দেশের অনুস্বাক্ষরের পর আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয়েছে। সেই আইনে এ ধরনের আন্তর্জাতিক নদীর অববাহিকায় যেসব দেশ রয়েছে, তাদের মধ্যে সমতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে ওই সব নদীর পানি ব্যবহারের একটি ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং ভারতের অংশে তিস্তা অববাহিকায় যে সেচব্যবস্থায় জমি রয়েছে, এর জন্য যে পানির প্রয়োজন, তার দাবি ভারত করতে পারবে। মোটকথা, ভারত অংশে তিস্তা অববাহিকায় যে সেচ অবকাঠামো আছে, তার জন্য পানি চাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এযাবৎকাল বিভিন্ন আলোচনায় ভারত পানির যে দাবি করছে, আমাদের জানামতে, এর মাত্র চার হাজার কিউসেক পানি গজলডোবা ব্যারাজের বাঁ ক্যানেলে প্রবাহিত হচ্ছে, যাকে ভারতের প্রকৃত তিস্তা অববাহিকা বলা যায়। এই পানির পরিমাণ অতি সামান্য। সুতরাং প্রশ্ন থেকে যায়, তাহলে ভারত যে তিস্তা প্রকল্পে প্রায় ২০ হাজার কিউসেক পানি দাবি করছে, তা কোথায় যাচ্ছে?

গুগলের ম্যাপে দেখা যায় যে গজলডোবা ব্যারাজের ভাটিতে নয়, কিছুটা উজানে এবং দক্ষিণে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি লিংক ক্যানেলের মাধ্যমে পানি অপর একটি আন্তর্জাতিক নদী মহানন্দায় নির্মিত ব্যারাজে প্রত্যাহার করা হচ্ছে। ভারতের ওই মহানন্দা ব্যারাজের যে সেচ এলাকা, তাকেই ভারত তাদের তিস্তার সেচ প্রকল্প বলে চালিয়ে দিচ্ছে, এটা আন্তর্জাতিক আইনের সম্পূর্ণ বরখেলাপ।

মনে রাখা দরকার, আন্তর্জাতিক নদীর এক অববাহিকার পানি অন্য অববাহিকায় নেওয়ার কারণে বহু দেশে আন্তর্জাতিক বিরোধের অবতারণা হয়েছে। সে জন্য এ ধরনের বিরোধ নিষ্পত্তি করতে ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘ ‘কনভেনশন অন দ্য ল অব দ্য নন-নেভিগেশনাল ইউজেস অব ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার কোর্সেস’-এর মাধ্যমে অববাহিকাভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক আইনের খসড়া প্রস্তুত করে। বহু বছরের আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার পর তা প্রয়োজনীয় ৪০টি দেশের অনুস্বাক্ষরের পর ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয়েছে। ফলে এখন আর একতরফাভাবে তিস্তার পানি অন্য নদীর অববাহিকায়, অর্থাৎ তিস্তার পানি মহানন্দায় প্রত্যাহারের কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। ফলে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা পেতে হলে আন্তর্জাতিক নদীর অভিন্ন অববাহিকাভিত্তিক এই আন্তর্জাতিক আইনের ওপর নির্ভর করা বাংলাদেশের স্বার্থের বিশেষ অনুকূল হবে। অথচ এই আইন বলবৎ হলে বাংলাদেশ এখনো তাতে অনুস্বাক্ষর করেনি।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে আরও উঠে এসেছে যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তঁাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তঁার এই মেয়াদেই, অর্থাৎ ২০১৮ সালের মধ্যেই তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি হয়ে যাবে। এই বণ্টন কিসের ভিত্তিতে হবে, তা কিছুটা অস্পষ্ট। তবে কিছুদিন ধরে বাংলাদেশ ও ভারতের পত্রপত্রিকায় এ বিষয়ে যেসব খবরাখবর প্রকাশিত হয়েছে তাতে বোঝা যায়, ২০১১ সালে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরের সময় চূড়ান্ত পর্যায়ে চুক্তি না হলেও যে সমঝোতার ভিত্তিতে চুক্তি হতে যাচ্ছিল, সে সমঝোতাই হয়তো চূড়ান্ত হয়ে রয়েছে। ওই সমঝোতায় পানি কোন হিসাবে বণ্টন করা আছে, সে বিষয়ে স্পষ্টভাবে কিছু জানা না গেলেও পত্রিকান্তরের খবরে বোঝা যায়, বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে প্রায় ৫ শতাংশ পানি কম পাবে। কোন পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ এ ধরনের খসড়ায় সম্মত হয়েছে, তার কোনো ব্যাখ্যা আমাদের জানা নেই। তবে মনে রাখতে হবে, সেটা ছিল ২০১১ সাল। তখন অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদীর পানিবণ্টনে ন্যায়নীতিভিত্তিক কোনো আন্তর্জাতিক আইন বলবৎ ছিল না। এখন আন্তর্জাতিক নদীর অববাহিকাভিত্তিক পানি ন্যায্যতা ও সমতার ভিত্তিতে বণ্টনের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটা আইন অন্তত আছে। সুতরাং ২০১১ সালে যদি একটি খসড়া সমঝোতায় বাংলাদেশ সম্মত হয়েও থাকে, তাহলে বর্তমান বাস্তবতায় তাতে আমাদের রাজি হওয়া উচিত হবে বলে মনে হয় না।

বাংলাদেশকে তার স্বার্থের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তিস্তার অববাহিকাভিত্তিক যেটুকু পানি বাংলাদেশের প্রাপ্য, তা কঠিনভাবে দাবি করতে হবে। এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে ২০১১ সালের সমঝোতার সময় আন্তর্জাতিক আইনের অনুপস্থিতির কারণে বাংলাদেশের পক্ষে পানির দাবিটি সঠিকভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। তিস্তা ভারত অংশে প্রায় সম্পূর্ণ একটি পাহাড়ি নদী। সেখানে সেচযোগ্য জমির পরিমাণ খুবই নগণ্য। ফলে অববাহিকাভিত্তিক পানিবণ্টনে ভারতের ভাগে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি পানি প্রাপ্য হতেই পারে না। গজলডোবা ব্যারাজের ভাটিতে ভারতে তিস্তা অববাহিকায় যে চাষযোগ্য সামান্য জমি রয়েছে, তার জন্য ভারত পানি দাবি করতে পারে। গজলডোবা ব্যারাজের বাঁ ক্যানেলে চার হাজার কিউসেক পানি দাবি করা হয়েছে। আমাদের জানামতে, এই এলাকা সম্পূরক সেচ প্রকল্প। অর্থাৎ ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত পানির দরকার। তখন তিস্তায় প্রয়োজনীয় পানি থাকে। এর জন্য পানি ভাগাভাগির প্রয়োজন নেই। যখন শুষ্ক মৌসুমে গজলডোবায় পানিপ্রবাহ প্রায় পাঁচ হাজার কিউসেকে নেমে আসে, তখনই সে পানি থেকে কোন দেশ কতটুকু নেবে, তা নিয়ে পানি ভাগাভাগি চুক্তির দরকার।

বাংলাদেশের তিস্তা প্রকল্পের আকার প্রায় ৫ লাখ হেক্টর এবং পানির প্রয়োজন প্রায় ১০ হাজার কিউসেক। এই বিবেচনায় বাংলাদেশের তিস্তা অববাহিকার যে বিশাল আকার, তাতে বাংলাদেশ অন্তত তিস্তার ৭০ শতাংশ পানির প্রাপ্যতা দাবি করতে পারে। আগেই বর্ণনা করা হয়েছে, গজলডোবা থেকে একটি লিংক ক্যানেলের মাধ্যমে ২৫ কিলোমিটার দূরে মহানন্দা ব্যারাজে পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। ভারতের তিস্তা প্রকল্প নামে যে প্রকল্প, যাতে ভারতে তিস্তার ডান ক্যানেলে যে প্রায় ১৬ হাজার কিউসেক পানির দাবি করা হচ্ছে, তা তিস্তা অববাহিকাই নয়। তা অন্য একটি আন্তর্জাতিক নদী, মহানন্দা নদীর অববাহিকা। ফলে তিস্তা আলোচনায় ওই মহানন্দা অববাহিকা এলাকা বাদ দিতে হবে। এই দাবি নতুন করে উপস্থাপন করলেই কেবল তিস্তার পানির ওপর বাংলাদেশের দাবির ন্যায্যতা জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। সব বিবেচনায় এর জন্য মহানন্দা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা জোরালোভাবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আলাদাভাবে উত্থাপন করতে হবে। মনে রাখা দরকার, মহানন্দা নদীর ন্যায্য পানির অভাবে প্রায় সারা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাই সেচের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সুতরাং মহানন্দার পানির দাবি কতটা জোরালোভাবে করা যাবে, তার ওপর হয়তো বাংলাদেশের তিস্তার পানিপ্রাপ্তি বহুলাংশে নির্ভর করবে।

এই দাবি কার্যকরভাবে আদায় করতে হলে ২০১৪ সালে আইনে পরিণত হওয়া আন্তর্জাতিক আইনের ওপর বাংলাদেশকে নির্ভর করতে হবে। ভাটি দেশের জন্য প্রণীত ওই আন্তর্জাতিক চুক্তিতে অবিলম্বে বাংলাদেশকে অনুস্বাক্ষর করতে হবে। এ জন্য জনমত গড়ে তোলা সচেতন নাগরিকদের দায়িত্ব বলে মনে করছি।

এবার আসি গঙ্গা ব্যারাজ প্রসঙ্গে। ভারত থেকে ফিরে আসার পর প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে গঙ্গা ব্যারাজ প্রসঙ্গও উঠে এসেছে। কিন্তু তাতে একটু হতাশাব্যঞ্জক চিত্র উঠে এসেছে। বাংলাদেশের আমলে গঙ্গা ব্যারাজের যেটুকু অগ্রগতি, তার প্রায় সবটুকু এই সরকারের গত আট বছরে অর্জিত হয়েছে। এ সময়ে ব্যারাজের সম্ভাব্যতা যাচাই ও ডিটেইল ডিজাইন সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পটি এখন বাস্তবায়নের জন্য দরপত্র আহ্বানের পর্যায়ে রয়েছে। অথচ সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এসবই নাকি ভুলের কারণে হয়েছে। পাংশায় গঙ্গা ব্যারাজে যে প্রস্তাবিত অবস্থান, তা নাকি ভুল জায়গা, বাংলাদেশের কোনো উপকারে আসবে না। ভারত-বাংলাদেশ উভয় দেশের যাতে উপকারে আসে, তেমন জায়গায় গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণের পক্ষে তিনি মত দিয়েছেন। বিষয়টি ব্যাখ্যা করা দরকার।

ব্যারাজ সমতল এলাকার নদীতে নির্মাণ করা হয়, যাতে নদীর পানির উচ্চতা পার্শ্ববর্তী কৃষিজমি থেকে উঁচু করে গ্রাভিটিতে অববাহিকার জমিতে সেচ দেওয়া যায়। ফলে উপকারভোগী এলাকা প্রধানত ব্যারাজের ভাটিতেই হয়। আন্তর্জাতিক সীমান্তের মাত্র ছয় কিলোমিটার উজানে ভারতের ফারাক্কা ব্যারাজ। সুতরাং ভারতের জন্য গ্রাভিটি সেচকাজে ব্যবহৃত হতে তেমন আরেকটি ব্যারাজ গঙ্গায় নির্মাণের জন্য কোনো জায়গাই আর ভারতে নেই। এর জন্য কোনো সময়সাপেক্ষ সমীক্ষার প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া গঙ্গায় যত সেচ অবকাঠামো, তার সবই ভারতের। ফারাক্কার উজানে ভারতে প্রায় ২০০ সেচ প্রকল্প রয়েছে। সেখানেই গঙ্গার প্রায় সব পানি ভারত একতরফাভাবে সেচের জন্য ব্যবহার করে আসছে। ফারাক্কায় ব্যারাজ নির্মাণের আগে পানির প্রবাহ ৮০ হাজার কিউসেক থাকত। শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গায় যে ৮০ হাজার কিউসেক পানি ছিল, তার ৪০ হাজার কিউসেক ভারত ফারাক্কায় একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। যে ২০-২৫ কিউসেক পানি হয়তো অবশিষ্ট থাকে, তার থেকে ভারতকে দেওয়ার তো কিছু নেই। দিলেও ভারত সে পানি অন্তত সেচের জন্য তো নিতে পারবে না। কারণ, ভারতে গঙ্গায় আরেকটি ব্যারাজ নির্মাণের জায়গা নেই।

এখন বাংলাদেশের কোথায় গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ করা যায়, সে বিষয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। বাংলাদেশে গঙ্গার যে ভৌগোলিক অবস্থান, তাতে হয়তো হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ভাটিতে ব্যারাজ নির্মাণ করা যায়, তাতে বৃহত্তর কুষ্টিয়া, বৃহত্তর যশোর ও বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলে কৃষিজমিতে সেচ দেওয়া যেতে পারে। সেই বিবেচনায় হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ভাটিতে গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের অবস্থান নির্ধারণ করা হয় বহু বছরের প্রচেষ্টায়, বহু অর্থ ব্যয়ে প্রায় ২ দশমিক ৫ লাখ একরে সেচের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ভবিষ্যতে গঙ্গা ব্যারাজ নির্মিত হলে এই সেচ অবকাঠামোকেই যাতে গঙ্গা ব্যারাজের প্রথম পর্যায় হিসেবে ব্যবহার করা যায়, সে লক্ষ্যেই সবকিছু করা হয়েছে।

কিন্তু সেখানে ব্যারাজ নির্মাণ করলে এবং পানির উচ্চতা বাড়ালে যে ‘ব্যাক ওয়াটার কার্ব’ হবে, তা ফারাক্কা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে কয়েক হাজার কোটি টাকায় বানানো ফারাক্কা ব্যারাজকে অকেজো করে দিতে পারে। এটা ভারতের মেনে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। সে জন্য পাকিস্তান আমলেই ব্যারাজের এই অবস্থান পরিত্যক্ত হয়। এরপর গড়াইমুখে তালবাড়িয়ায় নতুন অবস্থানে ব্যারাজের সমীক্ষা চালানো হয়। সেখানেও দেখা যায় যে ‘ব্যাক ওয়াটার কার্ব’ ভারত সীমান্ত অতিক্রম করে যায়। তা ছাড়া প্রস্তাবিত গঙ্গা ব্যারাজের অন্তত অর্ধেক সুবিধাভোগী এলাকা বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা। এই জেলায় গঙ্গার পানি ব্যবহার করতে হলে কারিগরি কারণে গড়াই নদী পার হয়ে আরও ভাটিতে ব্যারাজের অবস্থান নির্ধারণ করতে হয়। সে জন্যই বহু সমীক্ষার পর পাংশায় ব্যারাজের অবস্থান নির্ধারণ করা হয়। এতে ব্যারাজের ‘ব্যাক ওয়াটার কার্ব’ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমান্তের মধ্যেই থাকবে। ফলে ভারতের এ বিষয়ে আপত্তি দেওয়ার সুযোগ কম থাকবে। এই পাংশা ছাড়া বাংলাদেশ অংশে আর উজানে তো কোনো ব্যারাজের অবস্থান নেই। ফলে এখন এই ৫০ বছর সমীক্ষার পর ব্যারাজের অবস্থান নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির কোনো সুযোগ মনে হয় আর নেই। তবু এই অবস্থানেও ব্যারাজ নির্মাণ করলে গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্পের কার্যকারিতা সমানভাবে কার্যকর থাকবে।

প্রধানমন্ত্রী মৌখিকভাবে এ প্রকল্পকে বাতিল করে দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু বাংলাদেশের স্বার্থের বিষয়টি বিবেচনায় নিলে এটা বাতিল করার সুযোগ নেই। জলবায়ু পরিবর্তন, অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ এবং বিশ্বের উষ্ণতা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধির যে বিরূপ প্রভাব সারা বিশ্বের ওপর পড়েছে, তাতে বাংলাদেশও হুমকির মুখে। উষ্ণতার কারণে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। লবণাক্ততা বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলকে গ্রাস করেছে। ইতিমধ্যে বৃহত্তর খুলনা অঞ্চল ছাড়িয়ে যশোরে লবণাক্ততা প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশে যে প্রধান ফসল আউশ মৌসুম, তার যখন ফ্লাওয়ারিং সময়, অর্থাৎ তখন যদি ফসলের সম্পূরক সেচ না দেওয়া যায়, তবে প্রায় সব ধানই চিটা হয়ে যায়। এ বিপর্যয় রোধে গরিব কৃষক টিউবওয়েল বসিয়ে ফসল রক্ষার চেষ্টা করতে বাধ্য হন। ফলে অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির উচ্চতা উদ্বেগজনকভাবে কমে গেছে। পানিতে আর্সেনিকের পরিমাণ বেড়ে গেছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের হয়তো পঁাচ কোটি জনগোষ্ঠী আর্সেনিক দূষণে আক্রান্ত হয়েছে। বিশ্ব জলবায়ুর এ বিরূপ প্রভাবে অক্টোবর-নভেম্বর মাসের বৃষ্টি আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে। এ বিপর্যয় রোধে নদীর পানি ব্যবহারে সম্পূরক সেচব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। গঙ্গা ব্যারাজ নির্মিত হলে যে পানি ধরে রাখা সম্ভব হবে, তাতে সম্পূরক সেচের জন্য প্রয়োজনীয় পানির অভাব হবে না।

১৯৭৫ সালে যেদিন ফারাক্কা ব্যারাজ চালু হয়েছে, সেদিন ফারাক্কার লিংক ক্যানেলের মাধ্যমে ফারাক্কায় গঙ্গার যে ৮০ হাজার কিউসেক পানি ছিল, তার ৪০ হাজার কিউসেক পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথীতে একতরফাভাবে ভারত প্রত্যাহার করেছে। ওই এক সপ্তাহেই গড়াইমুখে গঙ্গার পানির উচ্চতা হঠাৎ পাঁচ মিটার পর্যন্ত পড়ে যায়। ফলে হঠাৎ গড়াইতে পানিপ্রবাহ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়। সেই থেকে বিগত ৪২ বছর শুকনো মৌসুমে পাঁচ মাস গড়াইতে পানিপ্রবাহ কম থাকে। গড়াইয়ের পানিপ্রবাহই শুষ্ক মৌসুমে খুলনা অঞ্চলে মিষ্টি পানির একমাত্র উৎস। এর অভাবে শুষ্ক মৌসুমে সমুদ্রের লোনাপানি খুলনা ও যশোরে চাষের জমি অনাবাদি করে দিচ্ছে। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব এই পরিস্থিতিকে আরও বিপর্যস্ত করে তুলেছে। বাংলাদেশের তিন কোটি প্রান্তিক মানুষ হুমকির মুখে পড়েছে। তারা উদ্বাস্তু হচ্ছে।

এই বিপর্যয় মোকাবিলা করতে হলে গড়াইতে মিষ্টি পানির প্রবাহ বৃদ্ধি করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। গঙ্গায় শুষ্ক মৌসুমে তো পানি নেই। ফলে সেচের জন্য না হলেও লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণের জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। এবং এর একমাত্র উপায় হলো গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ করে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি করে গঙ্গায় শুষ্ক মৌসুমে যে ২০-২৫ হাজার কিউসেক পানি আছে, তা গড়াইতে প্রবাহিত করা। তাতে লবণাক্ততা কার্যকরভাবে মোকাবিলা করা যাবে। সুন্দরবন নিয়ে যে এত মাতামাতি, আপনাদের হয়তো জানা আছে যে মিষ্টি পানির অভাবে গত ৪২ বছরে সুন্দরবন চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সুন্দরবনে আর সুন্দরীগাছ নেই বললেই চলে। এই বিশ্বঐতিহ্যকে রক্ষা করতে হলে সুন্দরবন অঞ্চলে পশ্চিম থেকে বেতনা, কপোতাক্ষ, শিবসা ও পশুর নদে মিষ্টি পানির প্রবাহ বৃদ্ধি করতে হবে। এর জন্য গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ করে গড়াই ও মাথাভাঙ্গায় মিষ্টি পানির প্রবাহ বাড়াতে হবে।

এই যখন পরিস্থিতি, তখন প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তাঁরই সময়ে বিগত আট বছরে নেওয়া গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প নাকি ভুল এবং সে কারণে তিনি তা বাতিল করেছেন। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য নিজেদের উদ্যোগে হলেও গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ করা দরকার। একে বাতিল করে দেওয়া কোনোভাবেই কাজের কাজ হবে না।

আবদুল আজিজ: প্রকৌশলী, অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত মহাপরিচালক, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড।