সোমবার, ৩ অক্টোবর, ২০১১

তিস্তা আমাদের অধিকার করিডোর ওদের আবদার


মাহমুদুর রহমান


ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর উচ্চ নিনাদে ঢাকঢোল পেটানো সাম্প্রতিক ঢাকা সফরের আগেরদিন ‘দেশপ্রেমিক হলে দেশের স্বার্থ দেখুন’ শিরোনামে যে মন্তব্য প্রতিবেদনটি লিখেছিলাম, সেখানে মূলত ট্রানজিটের মোড়কে করিডোর, পানি আগ্রাসন, বাণিজ্য ঘাটতি এবং সীমান্ত হত্যা, এই চারটি প্রসঙ্গ স্থান পেয়েছিল। সেই লেখায় তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সম্পর্কে যে আগাম মন্তব্যটি করেছিলাম, সেটি উদ্ধৃত করেই ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবং অমীমাংসিত ইস্যু বিষয়ক তিন কিস্তির মন্তব্য প্রতিবেদন শুরু করছি।

আমি লিখেছিলাম, “এদিকে দু’দিন আগে বলা হলো, তিস্তা নদীর পানিবণ্টনের বিষয়টি নাকি ড. মনমোহনের সফরের সময় দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের এজেন্ডা থেকেই বাদ দেয়া হয়েছে। কূটনৈতিক মহলে শোনা গেল, আলোচনা থেকে তিস্তাচুক্তি বাদ দেয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন একজন অতিমাত্রায় ভারতপন্থী উপদেষ্টা। সর্বশেষ সংবাদ অনুযায়ী অবশ্য তিস্তা পানিচুক্তি এজেন্ডায় ফেরত এসেছে। তবে সেই চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ কী পরিমাণ পানি পেতে যাচ্ছে, তা নিয়ে শুরু হয়েছে আর এক অনিশ্চয়তা। ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় লেখা হয়েছে, গজলডোবা পয়েন্টে পানি ৫২:৪৮ হারে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ভাগাভাগি হবে। অপরদিকে বিবিসি রেডিওতে পশ্চিমবঙ্গের ওই এলাকার সাংসদ বলেছেন, বাংলাদেশ নাকি মাত্র ২৫ শতাংশ পানি পাবে। উল্লেখ্য, গজলডোবা পয়েন্টের আগেই অন্তত ডজনখানেক স্থান থেকে ভারত তিস্তার পানি প্রত্যাহার করে চলেছে। অথচ এসব বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার নিশ্চুপ, জনগণ অন্ধকারে। তিস্তা নিয়ে প্রতিদিন যেভাবে নাটকের স্ক্রিপ্টের পরিবর্তন হচ্ছে, তাতে চুক্তি সই না হওয়া পর্যন্ত কোনো রকম ভরসা পাচ্ছি না।”
আমার আশঙ্কা সত্যে পরিণত হয়েছে, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি শেষ পর্যন্ত হয়নি। তবে চুক্তি না হওয়ার জন্য আমি এদেশের একজন নাগরিক হিসেবে যতটা হতাশ হয়েছি, তার চেয়েও বেশি উদ্বিগ্ন হয়েছি এই চুক্তি না হওয়ার পেছনের কারণটি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম মারফত জানতে পেরে। বাংলাদেশ এবং ভারতের ক্ষমতাসীন মহল তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তির নামে প্রকৃতপক্ষে এদেশের জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কল্যাণে সেই প্রতারণার বিষয়টি এখন ফাঁস হয়ে গেছে। বাংলাদেশের জনগণের তিস্তার পানির ন্যায্য অধিকারের প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করলেও একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে তার স্বচ্ছতার অবশ্যই
প্রশংসা করতে হবে। আমাদের দুই ‘সুপার’ উপদেষ্টা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিলে বাংলাদেশ ৪৮ শতাংশ পানি পাচ্ছে বলে প্রচারণা চালালেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কল্যাণে জানা গেল আমরা গজলডোবা পয়েন্টে মাত্র ৩৩ শতাংশ পানি পেতে যাচ্ছিলাম।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী দাবি করছেন, তার সম্মতিতে যে খসড়া চুক্তি প্রাথমিকভাবে প্রণীত হয়েছিল সেখানে বাংলাদেশের অংশ আরও অনেক কম অর্থাত্ ২৫ শতাংশ স্থির হয়েছিল। সম্ভবত সে কারণেই পশ্চিমবঙ্গের ওই এলাকার সাংসদ বিবিসি রেডিওতে প্রদত্ত সাক্ষাত্কারে তেত্রিশের পরিবর্তে ২৫ শতাংশের কথাই জানিয়েছিলেন। খসড়া এবং চূড়ান্ত চুক্তির মধ্যকার ফারাকের কারণেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শেষমুহূর্তে বেঁকে বসেছেন। উল্লেখ্য, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ তিস্তার পানির আধাআধি হিস্যা দাবি করে এসেছে। পানি নিয়ে এ ধরনের প্রতারণা ভারত অবশ্য আমাদের সঙ্গে নতুন করছে না। ১৯৭৫ সালে ভারত ফারাক্কা বাঁধ চালু করেছিল বাংলাদেশের তত্কালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে প্রতারণা করেই। 
১৯৭৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের ভারত সফর শেষে স্বাক্ষরিত যুক্ত বিবৃতির সূত্র ধরে ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে, এই ৪১ দিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা বাঁধ চালুর (Test run) ভারতীয় প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী থেকে রাষ্ট্রপতিতে রূপান্তরিত শেখ মুজিবুর রহমান। দুই দেশের সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল Feeder canal-এর এই অস্থায়ী Test run সম্পন্ন হলে উভয় দেশের মধ্যে গঙ্গার পানি ন্যায্যতার ভিত্তিতে ভাগাভাগি করে আনুষ্ঠানিক চুক্তি হওয়ার পরই কেবল ফারাক্কা বাঁধ স্থায়ীভাবে চালু করা হবে। 
বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ফারাক্কা নিয়ে বিতর্ক প্রসঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন। সেই বিবৃতির নিচের উদ্ধৃতাংশেও স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হচ্ছে যে, ১৯৭৫ সালে ফারাক্কা Test run একটি সাময়িক কার্যক্রম হওয়ারই কথা ছিল—
"It is to be hoped that this question will now be resolved at the next meeting and a firm and final solution found in a spirit of understanding and friendship safeguarding the legitimate rights and interests of both the countries. A significant step forward had been taken with the conclusion in April 1975 of a short term arrangement providing for the operation of the Feeder canal of the Farakka Barrage during the lean season last year, pending further discussions regarding the allocation of the lean season flows of the Ganga in terms of the Joint Declaration of the Prime Ministers of India and Bangladesh of May 16, 1974."
(আশা করা যাচ্ছে যে, সমঝোতা ও বন্ধুত্বের ভিত্তিতে পরবর্তী আলোচনায় এই সমস্যার এমন একটি স্থায়ী ও চূড়ান্ত সমাধানে উপনীত হওয়া সম্ভব হবে যাতে করে উভয় দেশের ন্যায্য অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষিত হয়। ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে ফারাক্কা বাঁধের সংযোগ খাল চালুর একটি স্বল্পকালীন ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে গত বছরের শুষ্ক মৌসুমের সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তবে ১৯৭৪ সালের ১৬ মে ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যৌথ বিবৃতির আলোকে শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানিবণ্টন সম্পর্কিত আলোচনা এখনও অমীমাংসিত রয়েছে।)
কিন্তু ভারত তার কথা রাখেনি। পরীক্ষামূলকভাবে মাত্র ৪১ দিনের জন্য বাঁধ চালু করার ছদ্মাবরণে তারা সেই যে ফারাক্কা বাঁধ থেকে গঙ্গার পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার শুরু করেছিল, তার অবসান আর কোনোদিন হয়নি। ফলে গত ৩৬ বছরে আমাদের এক সময়ের প্রমত্তা পদ্মা ক্ষীণকায়া স্রোতস্বিনীতে পরিণত হয়েছে এবং সেই সঙ্গে দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকাও আজ মরুকরণ প্রক্রিয়ায় পতিত। ফারাক্কা বাঁধ চালু হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান আর মাত্র সামান্য ক’টা দিন জীবিত ছিলেন। কাজেই আমাদের জানার উপায় নেই যে, তিনি ভারতীয় প্রতারণা সম্পর্কে আগাম জানতেন কিনা। দুর্ভাগ্যবশত তার কন্যার ক্ষেত্রে সেই benefit of doubt দেয়া যাচ্ছে না। বরঞ্চ, অবস্থাদৃষ্টে দেশবাসীর কাছে আজ পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশের ষোলো কোটি মানুষের সঙ্গে যে প্রতারণা করছে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী এবং দুই সুপার উপদেষ্টাসহ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। 
তিস্তাচুক্তি নিয়ে এই তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে এখন আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে পানির ন্যায্য হিস্যা প্রাপ্তির দরকষাকষিতে অধিকতর সতর্ক হতে হবে। গজলডোবা পয়েন্টের পানি শতকরা হারে ভাগাভাগির পরিবর্তে গ্যারান্টি ক্লজসহ পানির পরিমাণ (হাজার কিউসেক) নিশ্চিত করা গেলেই কেবল বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে। যেনতেন একটি চুক্তি বাংলাদেশের জন্য বরং অমঙ্গলই ডেকে আনবে। ঝানু কূটনীতিকরা বলে থাকেন, "No treaty is better than a bad treaty" (চুক্তি না থাকা খারাপ চুক্তির চাইতে ভালো)। তিস্তা নদীতে মোট পানিপ্রবাহের পরিমাণের অঙ্ক নির্ধারণেও বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক পানি বিশেষজ্ঞদের অবিলম্বে সম্পৃক্ত হওয়া আবশ্যক, যেন সেখানেও বর্তমান সরকার এবং বাংলাদেশের ভারতবন্ধুরা মিলে আমাদের কোনো শুভঙ্করের ফাঁকিতে ফেলতে না পারে।
সেই পাকিস্তান আমল থেকেই ভারত আমাদের বিরুদ্ধে অব্যাহত পানি আগ্রাসন চালালেও প্রতিবেশী রাষ্ট্রটির সব প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আমরা কেবল আশ্বাসবাণীই শুনে এসেছি। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প বাতিলের দাবির প্রেক্ষিতে ড. মনমোহন সিং তার পূর্বসূরিদের চর্বিত চর্বণ পুনরাবৃত্তি করে ঢাকায় বলেছেন, “ভারত এমন কিছু করবে না যাতে বাংলাদেশের জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।” বছরের পর বছর ধরে এই অভিন্ন বাক্য শুনতে শুনতে বাংলাদেশের জনগণ ক্লান্ত হয়ে পড়লেও আশ্চর্যজনকভাবে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীদের একই কথা বলাতে যেন কোনো ক্লান্তি নেই। 
শেখ হাসিনা এবারের মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর মিসরের রাজধানী কায়রোতে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে ড. মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে প্রথমবার আনুষ্ঠানিক বৈঠক শেষে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে অবিকল একই মন্তব্য করেছিলেন। অথচ ভারত বরাক নদীতে বাংলাদেশের জন্য আরও একটি মরণ বাঁধ নির্মাণ থেকে সরে আসার কোনো প্রতিশ্রুতি আজ পর্যন্ত দেয়নি। ১৯৫১ সালে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ পরিকল্পনা আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমে ফাঁস হয়ে গেলে পাকিস্তান সরকারের উদ্বেগের জবাবে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুও এই কথাই বলেছিলেন। ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ফলে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হয়নি, বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে ষাট বছর পর এমন দাবি ‘র’ (raw)-এর বেতনভুক বাংলাদেশী এজেন্টরাই কেবল করতে পারেন।
যা হোক, শেষ কথা হলো মহাজোট সরকার তিস্তার পানি নিয়ে আমাদের আশার এক প্রকাণ্ড বেলুন ফুলিয়ে তুললেও তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি করতে ভারত চূড়ান্ত মুহূর্তে অসম্মতি জ্ঞাপন করেছে। ড. মনমোহন সিং বাড়ি বয়ে এসে শেখ হাসিনাকে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন, নতজানু পররাষ্ট্রনীতি দিয়ে দেশের কোনো কল্যাণ সাধন হতে পারে না। এখন বাংলাদেশের জন্য অধিকতর আশঙ্কার বিষয় হলো, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরের ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই গণবিরোধী, ভারতপন্থীরা আমাদের স্বাধীনতা হরণের নতুন কৌশল প্রণয়নে কোমর বেঁধে লেগে গেছে। 
এই গোষ্ঠী টেলিভিশন ‘টক শো’ এবং পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে তিস্তার পানির সঙ্গে করিডোর বিনিময়ের একটি পটভূমি তৈরির অপচেষ্টায় জনগণের মগজ ধোলাইয়ের কাজ ইতোমধ্যে শুরু করে দিয়েছেন। সরকারের সর্বোচ্চ মহলের নির্দেশেই যে এরা মাঠে নেমেছেন, তার প্রমাণ বিতর্কিত ‘সুপার উপদেষ্টা’ ড. গওহর রিজভীর আরটিভিতে ৮ তারিখের লাইভ ইন্টারভিউতেই মিলেছে। শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রথম মেয়াদের পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীর তিস্তার পানি এবং করিডোর, এই দুই বিষয়কে এক না করার পরামর্শের জবাব এড়িয়ে ড. গওহর রিজভী দ্বিপাক্ষিক লেনদেনের বায়বীয় গল্প বলে সরকারের অস্বচ্ছ, রাষ্ট্রবিরোধী অবস্থানকেই পুনর্বার স্পষ্ট করেছেন। একটি চিহ্নিত কট্টর ভারত ও সরকারপন্থী পত্রিকায় ৯ সেপ্টেম্বর ‘আধাঘণ্টায় পাল্টে যায় পরিস্থিতি’ শিরোনামের লিড নিউজে লেখা হয়েছে, “আধাঘণ্টায় বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের সব পরিস্থিতি পাল্টে যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণতায় বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় ঘুরে দাঁড়ায়। তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তির সঙ্গে বাদ পড়ে যায় ট্রানজিটের সম্মতিপত্র সইও।”
মার্কিন ও ভারতপন্থী সুশীল (?) পত্রিকা দি ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম ওই ৯ তারিখেই তাদের সহযোগী বাংলা পত্রিকা প্রথম আলোতে লিখেছেন, “দুই দেশের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের কাছে ভারতের চাওয়ার প্রধান বিষয়—নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ও ট্রানজিট সুবিধা। নিরাপত্তার নিশ্চয়তা আগেই দেয়া হয়েছে। ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার ব্যাপারেও বাংলাদেশ নীতিগত সম্মত হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রধান বিষয়—অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা এবং বাণিজ্য-বৈষম্য কমানো। দ্বিতীয়ত, ভারত কেন ট্রানজিট চাইছে? উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য। আমরা কেন পানি চাইছি? আমাদের উন্নয়নের জন্য।” কী চমত্কারভাবেই না আমাদের ন্যায্য অধিকারকে ভারতের আধিপত্যবাদী আবদারের সঙ্গে উন্নয়নের নামে তুলনীয় করে দেখানো হয়েছে! মাহফুজ আনাম এবং তার স্বগোত্রীয়রা দীর্ঘদিন ধরে ভারতকে করিডোর দেয়ার পক্ষে ওকালতি করে চলেছেন। সেদিন মাছরাঙা টেলিভিশনে এক সাক্ষাত্কারে ট্রানজিটের মোড়কে করিডোরের পক্ষে তার নীতিগত অবস্থানের কথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করে তিনি অবশ্য সততার পরিচয় দিয়েছেন।
আসল কথা হলো, প্রচারণার মাধ্যমে জনগণকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হচ্ছে, যাতে ষোলো কোটি মানুষের অধিকারকে সাম্রাজ্যবাদী প্রতিবেশীর আবদারের কাছে বিসর্জন দিলেও দেশে কোনো কার্যকর প্রতিবাদের ঝড় না ওঠে। একথা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশের গণমাধ্যমে ভারতপন্থীদের লক্ষণীয় প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশের স্বার্থ বিকিয়ে ভারতের সন্তুষ্টি অর্জনই যাদের মোক্ষ, সেই গোষ্ঠী গত দুই দশক ধরে করিডোরের বিনিময়ে ঐশ্বর্য প্রাপ্তির এক অবাস্তব স্বপ্ন ফেরি করে বেড়িয়েছেন। ড. মনমোহনের সফর বাংলাদেশের মোহাবিষ্ট জনগণকে অবশেষে এক জোরদার ঝাঁকুনি দিয়ে কঠিন বাস্তবে নামিয়ে এনেছে। সেই বিবেচনায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে নিষম্ফল সফর আমার বিবেচনায় একেবারে বৃথা হয়নি। রাস্তাঘাটের আলাপচারিতায় আমার কাছে অন্তত মনে হচ্ছে, একাত্তরের মহান মুক্তিসংগ্রামের সেই স্বাধীনতার স্ফুলিঙ্গ দীর্ঘকাল বাদে গণমানসে আবার যেন দেখতে পাচ্ছি। কবি ফরহাদ মজহারের প্রত্যাশামত এদেশের জনগণের হুঁশ বোধহয় ফিরতে শুর করেছে। ১৯৭১ সালে পিন্ডি যদি আমাদের ‘দাবায়ে’ রাখতে না পেরে থাকে, ইন্শাআল্লাহ্ ২০১১-তে দিল্লিও পারবে না।
বাংলাদেশের জনগণের উপলব্ধি করা কর্তব্য যে, আমাদের মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার স্বার্থে ভারতকে করিডোর দেয়ার প্রস্তাবে আমরা স্বপ্নে প্রাপ্ত কোনো ‘প্রাচুর্যের’ বিনিময়েই সম্মত হতে পারি না। আধিপত্যবাদী প্রতিবেশীকে একবার করিডোর দেয়া হলে এদেশে অশান্তি ও যুদ্ধবিগ্রহ অবশ্যম্ভাবী। ভারতের উত্তর-পূর্বের সাত রাজ্যের প্রতিটিতেই সেই ১৯৪৭ সাল থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদী সহিংস আন্দোলন চলছে। সেসব সশস্ত্র সংগঠনকে দমনের জন্য বিপুলসংখ্যায় ভারতীয় কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ছয় দশক ধরে কেবল সেখানে অবস্থানই করছে না, আকাশ ও স্থলপথে তাদের বিদ্রোহ দমনের জন্য নিয়মিত প্রয়োজনীয় সামরিক রসদও প্রেরণ করা হচ্ছে। ভারতের মূল ভূখণ্ড এবং সাত রাজ্যের মাঝখানে বাংলাদেশের অবস্থান হওয়ার কারণে স্থলপথে রসদসমূহ জলপাইগুড়ির চিকেন নেক ঘুরে পাঠাতে হচ্ছে। ফলে একদিকে ভারত সরকারের যেমন ব্যয় বৃদ্ধি হচ্ছে, অপরদিকে বিরোধীপক্ষের সামরিক আক্রমণে চিকেন নেক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কাও সার্বক্ষণিকভাবে থেকে যাচ্ছে।
সুতরাং মুখে উন্নয়নের কথা প্রচার করা হলেও প্রকৃতপক্ষে সামরিক স্বার্থেই বাংলাদেশের বুক চিরে ভারতের করিডোর আবশ্যক। চীনের সঙ্গে ভারতের সম্ভাব্য সংঘর্ষের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ষোলো কোটি মানবসন্তানের এক দরিদ্র ও শান্তিপ্রিয় জনগোষ্ঠী। এশিয়ার দুই বৃহত্ শক্তির দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িত হওয়ার কোনো ইচ্ছা আমাদের নেই। বাংলাদেশের বর্তমান শাসকশ্রেণী ভারতকে করিডোর দিয়ে সেই দ্বন্দ্বে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করার অপচেষ্টায় রত হয়েছে। তাছাড়া ভারতে বিভিন্ন দ্বন্দ্ব-সংঘাতের প্রতিক্রিয়ায় জঙ্গিবাদ এক বিপজ্জনক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। এই উপমহাদেশের তিনটি রাষ্ট্রের মধ্যে বাংলাদেশই সামগ্রিকভাবে জঙ্গিবাদমুক্ত রয়েছে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী যখন বাংলাদেশ সফর করছিলেন, সেই সময় দিল্লি হাইকোর্টে সন্ত্রাসী হামলায় শতাধিক ব্যক্তি হতাহত হয়েছে। করিডোর প্রদান করে আমরা এদেশে জঙ্গিবাদ আমদানির ঝুঁকি নিতে পারি না। বর্তমান সরকারের দেশের স্বার্থবিরোধী এসব কর্মকাণ্ডকে প্রতিহত করতে হলে দেশপ্রেমিক জনতার প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
তাছাড়া অর্থনৈতিক বিবেচনাতেও করিডোর প্রদান দেশের জন্য কোনো সুফল বয়ে আনবে না। এ বিষয়টি বুঝতে পেরেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টারা এখন দেশবাসীকে প্রত্যক্ষ লাভের বদলে পরোক্ষ আয়ের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুরে পরিণত করার স্বপ্ন দেখানো ফতোয়াবাজরা ভোল পাল্টে সরকারকে সম্প্রতি ধীরে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন। অবশেষে শুভবুদ্ধির উদয় হওয়ার জন্য এসব মরশুমী বুদ্ধিজীবীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ড. গওহর রিজভী নতুন থিওরি কপচাচ্ছেন, শুল্ক তেমন একটা পাওয়া না গেলেও ভারতীয় ট্রাক ড্রাইভারদের সেবায় বাংলাদেশে হোটেল-রেস্তোরাঁ খুললে সেখান থেকেই আমাদের প্রচুর আয়-রোজগার হবে! এর আগে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ফতোয়া দিয়েছিলেন যে, একটি ‘ট্রানজিট রাষ্ট্র’ হওয়ার জন্যই নাকি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। একই অর্থমন্ত্রী এমন দাবিও করেছেন যে, ২০১০ সালেই তারা ভারতকে ট্রানজিট দিয়ে দিয়েছেন।
অপরদিকে ড. গওহর রিজভী এবং ড. মসিউর রহমান মনে করেন, ১৯৭২ এবং ১৯৭৪ সালে প্রণীত বাণিজ্য চুক্তি ও মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতেই নাকি মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান ভারতকে ট্রানজিট দিয়ে গেছেন। আমার বিবেচনায় এসব বক্তব্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য কেবল অবমাননাকরই নয়, সেই সঙ্গে রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলকও। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে অপসংস্কৃতির সঙ্গে ভারতীয় মাদক আগ্রাসনেরও শিকারে পরিণত হয়েছে। করিডোর দেয়া হলে তরুণদের মধ্যে ভারতীয় মাদকের ব্যবহার বৃদ্ধির পাশাপাশি অন্যান্য আনুষঙ্গিক অপরাধপ্রবণতাও এদেশে বৃদ্ধি পেতে বাধ্য। মরণব্যাধি ‘এইডসে’র মহামারীতে ভারত বর্তমানে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। এ ধরনের ব্যাধি বিভিন্ন দেশে ভারী যানবাহন চালকদের মাধ্যমেই সচরাচর সংক্রমিত হয়ে থাকে। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, বর্তমান সরকার বাংলাদেশকে সর্বদিক থেকে একটি বিপজ্জনক রাষ্ট্রে পরিণত করতে উদ্যত হয়েছে। আগামী প্রজন্মকে নিরাপদ করতে হলে এদের প্রতিহত না করে উপায় নেই।
আসুন সমস্বরে বলি, তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা ভারতকে দিতেই হবে, কারণ এটা আমাদের অধিকার। এবং সেই পানির বিনিময়ে করিডোর প্রদানের অপকৌশল আমরা কিছুতেই বাস্তবায়ন হতে দেবো না। ড. মনমোহন সিং তার এই সফরে বাংলাদেশের প্রকৃত স্বাধীনতা হরণের অর্ধেকটা Framework Agreement স্বাক্ষর করতে শেখ হাসিনা সরকারকে বাধ্য করার মাধ্যমে সম্পন্ন করেছেন। এরপর করিডোর নিতে পারলেই বাংলাদেশকে আক্ষরিক অর্থেই একটি vassal state (পোষ্য রাষ্ট্র)-এ রূপান্তর করা যাবে। এ বিষয়ে দ্বিতীয় কিস্তিতে বিশদভাবে লেখার ইচ্ছে রইল। করিডোর প্রদানের সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেই এ সপ্তাহের মন্তব্য প্রতিবেদন সমাপ্ত করছি।
মন্তব্য প্রতিবেদন : ভারতের ভূমি আগ্রাসন
ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবং দুই দেশের মধ্যকার অমীমাংসিত বিষয়গুলোর ওপর আমার তিন কিস্তির লেখার প্রথম কিস্তিতে ফারাক্কা বাঁধ পরীক্ষামূলকভাবে চালু সম্পর্কিত ভারতীয় প্রতারণার ঘটনা উল্লেখ করেছিলাম। দ্বিতীয় কিস্তি আরম্ভ করছি বেরুবাড়ী নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে প্রতারণার কাহিনী বর্ণনা করে।
১৯৭৪ সালের ১৬ মে দিল্লিতে শেখ মুজিবুর রহমান এবং ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবিষয়ক যে চুক্তি সম্পাদিত হয়, তার ১নং ধারার (Article 1) ১৪নং উপধারাটি ছিল বেরুবাড়ী সংক্রান্ত। উপধারাটি নিম্নরূপ:
"India will retain the southern half of South Berubari Union No. 12 and the adjacent enclaves, measuring an area of 2.64 Square miles approximately, and in exchange Bangladesh will retain Dahagram and Angorpota enclaves. India will lease in perpetuity of Bangladesh an area of 178 metres 85 metres near `Tin Bigha' to connect Dahagram with Panbari Mouza (P.S. Patgram) of Bangladesh.
(ভারত দক্ষিণ বেরুবাড়ী ইউনিয়ন নং ১২-এর দক্ষিণার্ধ এবং সংলগ্ন ছিটমহলসমূহ যার আয়তন প্রায় ২.৬৪ বর্গমাইল তার অধিকারে রাখবে এবং বিনিময়ে বাংলাদেশ দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা ছিটমহল তার অধিকারে রাখবে। ভারত চিরস্থায়ী লিজের ভিত্তিতে বাংলাদেশকে তিনবিঘার কাছে ১৭৮ মিটার ৮৫ মিটার জায়গা প্রদান করবে যাতে দহগ্রাম বাংলাদেশের পানবাড়ী মৌজার [থানা পাটগ্রাম] সঙ্গে সংযুক্ত হয়।) 
চুক্তির ৫নং ধারায় (Article 5) চুক্তি কার্যকর ও বাস্তবায়নের নিম্নোক্ত পন্থা বর্ণিত হয়, 
"This instrument shall be subject to ratification by the Governments of India and Bangladesh and instruments of ratification shall be exchanged as early as possible. The Agreement shall take effect from the date of the exchange of the Instruments of Ratification."
(এই দলিলটি ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদনসাপেক্ষ এবং অনুমোদনের একটি দলিল উভয় পক্ষের মধ্যে যত দ্রুত সম্ভব বিনিময় করা হবে। অনুমোদন দলিল বিনিময়ের তারিখ থেকে
এই চুক্তি বলবত্ হবে।)
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি ‘সরল’ বিশ্বাসে শেখ মুজিবুর রহমান চুক্তি অনুযায়ী ১৯৭৪ সালের ২৮ নভেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদে চুক্তি অনুমোদন করিয়ে নেন। এখানে উল্লেখ্য, শেখ মুজিবুর রহমানের সেই সংসদও বর্তমান সংসদের অনুরূপ প্রায় একদলীয় ছিল। সংবিধান (তৃতীয় সংশোধন) আইন, ১৯৭৪ পাঠকের জ্ঞাতার্থে এখানে আংশিক উদ্ধৃত করছি—
“গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও প্রজাতন্ত্রী ভারত সরকারের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি কার্যকর করিবার উদ্দেশ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের কতিপয় বিধানের অধিকতর সংশোধনকল্পে প্রণীত আইন।
যেহেতু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও প্রজাতন্ত্রী ভারত সরকারের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি কার্যকর করিবার উদ্দেশ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের কতিপয় বিধানের অধিকতর সংশোধন সমীচীন ও প্রয়োজনীয়;
সেইহেতু এতদ্বারা নিম্নরূপ আইন করা হইল :-
১. সংক্ষিপ্ত শিরনামা ও প্রবর্তন।—(১) এই আইন সংবিধান (তৃতীয় সংশোধন) আইন, ১৯৭৪ নামে অভিহিত হইবে।
(২) ৩ ধারা ব্যতীত ইহা অবিলম্বে বলবত্ হইবে এবং ৪ ধারার অধীন বিজ্ঞপ্তিতে বর্ণিত তারিখে ৩ ধারা বলবত্ হইবে।”
মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির ৫ নম্বর ধারায় পরিষ্কার উল্লেখ ছিল যে, উভয় সরকারের অনুমোদনের দলিল বিনিময়ের পরই কেবল চুক্তি বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু, অভাবিতভাবে ভারতের কাছ থেকে সে রকম কোনো অনুমোদন দলিল কিংবা তিনবিঘা করিডোরের চিরস্থায়ী লিজ প্রাপ্তি ব্যতিরেকেই ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতার ভারে নতজানু বাংলাদেশের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বেরুবাড়ী ছিটমহল ভারতকে হস্তান্তর করেন। অপরদিকে ভারত তাদের সংসদে বিষয়টি অনুমোদন না করে ঝুলিয়ে রাখে এবং আদালতে মামলার অজুহাতে তিনবিঘা করিডোর আমাদের না দিয়েই বেরুবাড়ী হস্তগত করে নেয়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ তার প্রাপ্য তিনবিঘা করিডোরের চিরস্থায়ী লিজ পায়নি।
ড. মনমোহন সিংয়ের সফরের আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৬ বছর দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার অধিবাসীদের নিজ গৃহে পরবাসীর মতো গ্লানিকর জীবনযাপন করতে হয়েছে। বছরের পর বছর তারা ছিটমহল থেকে নিজ দেশে আসার জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতির আশায় বসে থেকেছে। বিএসএফ ইচ্ছে হলে অনুমতি দিয়েছে, অধিকাংশ সময়ই দেয়নি। তারপর কয়েক দশকের অনেক দেন-দরবার শেষে দিনের বারো ঘণ্টা বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ পেলেও রাতের বারো ঘণ্টা ছিটমহলবাসীকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী দ্বারা অবরুদ্ধ থাকতে হয়েছে। নিদারুণ অসুস্থতার সময়ও তারা জেলা হাসপাতালে চিকিত্সার সুযোগ পায়নি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের সুবাদে দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতায় বাংলাদেশী নাগরিকদের দীর্ঘ তিন যুগের বন্দিত্বের অবসান হয়েছে। তারা এখন থেকে চব্বিশ ঘণ্টাই মূল ভূখণ্ডে যাওয়া-আসা করতে পারবেন। তবে, কারাগারের দরজা খোলা হলেও আমরা চুক্তি অনুযায়ী করিডোরের চিরস্থায়ী লিজ পেয়েছি কিনা, সেটা এখনও দেশবাসীর অজানাই রয়ে গেছে। যে দরজাটি ভারত চব্বিশ ঘণ্টা খোলা রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সেটি আবারও বন্ধ হবে কিনা তাও জানি না।
ছত্রিশ বছর ধরে চুক্তি প্রতিপালন না করার অপরাধে যেখানে ভারতের নিন্দা প্রাপ্য ছিল, সেখানে এ দেশের ভারতবান্ধব মিডিয়া, রাজনীতিবিদ এবং সুশীল (?) গোষ্ঠী সামান্য দরজা খোলা নিয়েই ড. মনমোহন সিং ও শেখ হাসিনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন! চব্বিশ ঘণ্টা ছিটমহলের দরজা খোলা রাখাকেই মহাজোট সরকার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের বিরাট সাফল্য হিসেবে বর্ণনা করে চলেছে। কিন্তু যে কোনো বিবেকসম্পন্ন নাগরিকই বুঝবেন ১৯৭৪ সালের চুক্তি অনুযায়ী বিষয়টি কেবল দরজা খোলা অথবা বন্ধ সংক্রান্ত নয়, বেরুবাড়ী দেয়ার পরিবর্তে অতিশয় ক্ষুদ্র করিডোরটি বাংলাদেশের প্রাপ্য অংশ। ভারত আমাদের এতদিন ‘হাইকোর্ট’ দেখিয়ে একতরফাভাবে চুক্তি ভঙ্গ করেছে এবং তিনবিঘা করিডোর হস্তান্তরের পরিবর্তে সেখানে দরজা লাগিয়ে, পাহারা বসিয়ে ছিটমহলবাসীদের বন্দি জীবনযাপনে বাধ্য করেছে। এখন আবার ওদের প্রচার মাধ্যম মারফত শুনতে পাচ্ছি, ছিটমহলের চারদিকে নাকি কাঁটাতারের বেড়াও নির্মাণ করা হবে। প্রকৃতপক্ষে, মানসিক বন্দিত্ব থেকে দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতার বাংলাদেশী নাগরিকদের মুক্তি দিতে ‘মহান’ প্রতিবেশী ভারত এখনও নারাজ।
এবার দেখা যাক ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতে ভারত ও বাংলাদেশের অন্যান্য ছিটমহলবাসীর দুঃখ-কষ্ট নিরসনে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। চুক্তির এক নম্বর ধারার ১২ নম্বর উপধারাটি নিম্নরূপ, 
"The Indian enclaves in Bangladesh and the Bangladesh enclaves in India should be exchanged expeditiously, excepting the enclaves mentioned in paragraph 14 without claim to compensation for the additional area going to Bangladesh."
(১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত ছিটমহল ব্যতীত বাংলাদেশের ভেতরে অবস্থিত ভারতীয় সকল ছিটমহল এবং ভারতের অভ্যন্তরের বাংলাদেশের ছিটমহলসমূহ দ্রুততার সঙ্গে বিনিময় করা হবে এবং বাংলাদেশের অতিরিক্ত ভূমি প্রাপ্তির বিনিময়ে কোনো ক্ষতিপূরণ প্রদত্ত হবে না।)
উদ্ধৃত উপধারায় যে ১৪ অনুচ্ছেদের কথা বলা হয়েছে সেটি দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা সম্পর্কিত, যার আলোচনা এর মধ্যেই করেছি।
মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি স্বাক্ষরের পর ভারতের তত্কালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং (Swaran Singh) ১৯৭৪ সালের ২২ জুলাই লোকসভায় নিম্নোক্ত বিবৃতি প্রদান করেন—
"The whole of Berubari will remain with India while the Bangladesh enclaves of Dahagram and Angarpota will remain with that country. All other enclaves of the two countries will be exchanged. We will also lease to Bangladesh an area to connect the enclaves of Dahagram and Angarpota with Bangladesh while ensuring that our nationals retain the facility of passage across this area.
As demarcation takes place, territories in the adverse possession of one or the other country will come to light. These will be exchanged; and we have agreed that the people in areas which are transferred will be given the right of staying on where they are as national of the State to which the areas are transferred."
(সম্পূর্ণ বেরুবাড়ী ভারতের অধিকারে থাকবে এবং বাংলাদেশের দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা ছিটমহল তাদের অংশ হবে। অন্য সকল ছিটমহল দুই দেশের মধ্যে বিনিময় করা হবে। আমাদের নাগরিকদের যাতায়াতের অধিকার সংরক্ষিত রেখে দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতার সঙ্গে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড সংযোগের জন্য একটি জায়গা লিজ দেয়া হবে। সীমান্ত চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়াকালে দুই দেশের মধ্যে প্রতিকূল অবস্থায় পতিত ভূখণ্ড ক্রমান্বয়ে নজরে আসবে। এই জায়গাগুলো বিনিময় করা হবে এবং আমরা সম্মত হয়েছি যে, জনগণ যার যার জায়গায় অবস্থান করেই ছিটমহল বিনিময় পরবর্তী রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ার অধিকার ভোগ করবে।)
একই বছরের ২৬ জুলাই ভারতীয় রাজ্যসভায় প্রশ্নোত্তরকালে তত্কালীন স্টেট মিনিস্টার সুরেন্দ্র পাল সিং (Surendra Pal Singh) রাজ্যসভার সদস্যদের অবহিত করেন যে, ১৯৫৮ সালে সম্পাদিত ভারত ও পাকিস্তানের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহরু ও ফিরোজ খান নূন (নেহরু-নূন চুক্তি) এর মধ্যকার সম্পাদিত চুক্তির আলোকেই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তিনি রাজ্যসভাকে আরও জানান যে, ছিটমহল বিনিময় সমাপ্ত হলে ভারত এবং বাংলাদেশ যথাক্রমে ৭ ও ৭.২১ বর্গমাইল ভূমিপ্রাপ্ত হবে। (The area thus be retained by India is estimated at approximately 7.0 square miles and the area retained by Bangladesh at 7.21 square miles.)
ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের পর আমরা দেখতে পাচ্ছি, ছিটমহল বিনিময়ের বিষয়টি আগের মতোই হিমাগারে রেখে কেবল তথাকথিত অপদখলীয় জমি হস্তান্তর হচ্ছে। এর ফলে একতরফাভাবে ভারত লাভবান হচ্ছে। এর মধ্যেই আসাম আমাদের ভূখণ্ড থেকে ১২৩৯ একর জমি পেয়েছে যার বিনিময়ে আমরা পেয়েছি মাত্র ৩৫৭ একর জমি। একইভাবে মেঘালয় রাজ্যকে ২৪০ একর জমি ছেড়ে দেয়ার বিনিময়ে আমরা মাত্র ৪১ একর পেয়েছি। আসাম এবং মেঘালয় থেকে আমাদের যত্সামান্য জমি প্রাপ্তি নিয়েও সংশয় রয়েছে। ওই দুই রাজ্যে বিজেপি’র নেতৃত্বে অন্যান্য বিরোধীদল স্থানীয় অধিবাসীদের নিয়ে বাংলাদেশকে জমি প্রদানের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছে। তিনবিঘা করিডোর নিয়ে ভারত আমাদের সঙ্গে যে প্রতারণা করেছিল, অপদখলীয় জমির বিনিময় নিয়েও একই প্রকার প্রতারণার আশঙ্কা অবস্থাদৃষ্টে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।
দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলোর কাছ থেকেও এখন পর্যন্ত জাতীয় স্বার্থ রক্ষার্থে কোনো দৃঢ় ও পরিষ্কার অবস্থান দেশবাসী দেখতে পায়নি। বৃহত্তর সিলেটের সীমান্ত এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত জনসাধারণ তাদের সাধ্যমত বিক্ষোভ-সমাবেশ করলেও রাজধানীতে তার কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। ক্ষমতার রাজনীতিতে অভ্যস্ত শাসকশ্রেণী বাংলাদেশের অসহায় নাগরিকদের পাশে দাঁড়ানোর পরিবর্তে ভারতকে সন্তুষ্ট রেখেই তাদের রাজনীতি করতে অধিকতর আগ্রহী বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। অপদখলীয় জমি বিনিময়ে বাংলাদেশের জনগণ বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে প্রভূত লাভবান হচ্ছেন। আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা এর মধ্যেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তাদের সুগভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। মহাজোট নেত্রী শেখ হাসিনাকে এখন ওইসব রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদানেরও প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়েছে। সম্ভবত, আগামী মাস থেকেই আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সেসব ডিগ্রি আহরণ অভিযান শুরু হবে।
নরওয়ের নোবেল কমিটি শেখ হাসিনার মর্যাদা না বুঝলেও ভারত কিন্তু যথাযথ প্রতিদান দিতে কসুর করছে না। অপদখলীয় জমি বিনিময়ের ব্যাপারে শেখ হাসিনা সরকার অতিউত্সাহী হলেও ছিটমহলবাসীদের দীর্ঘ ৬৪ বছরের সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কোনো মাথাব্যথা নেই। আর কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে ভারত ও বাংলাদেশ উভয় রাষ্ট্রের ছিটমহলের অসহায়, দরিদ্র মানুষগুলো এখন অহিংস আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছেন। তারা অনশন করছেন, নিষ্প্রদীপ মহড়া করে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল ইত্যাদি কর্মসূচির মাধ্যমে ভারত ও বাংলাদেশের উদাসীন শাসকদের দৃষ্টি আকর্ষণের যথাসম্ভব চেষ্টা চালাচ্ছেন।
শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের কাছ থেকে বার বার প্রতারিত হওয়া সত্ত্বেও তারই কন্যা ইতিহাস থেকে কোনো শিক্ষা নেবেন না বলে ধনুর্ভঙ্গ পণ করেছেন। তিনি এবং তার সুপার উপদেষ্টারা ভারত প্রেমে এতটাই বেহুঁশ যে, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির কোনো রকম স্বার্থ তারা বিবেচনাতেই আনছেন না। দুই ‘সুপার’ উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী ও ড. মসিউর রহমান এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি তো প্রেমের পরীক্ষায় আরব্য উপন্যাসের বিখ্যাত মজনুকেও হার মানিয়েছেন। এমন দিওয়ানা শ্রেণীর হাতে রাষ্ট্র কিংবা জনগণের স্বার্থ কোনোটিই নিরাপদ নয়। ভারত শুধু যে সম্পাদিত চুক্তি বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা অবলম্বন করে বাংলাদেশকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখছে তাই নয়, আমাদের দেশের চারদিক ঘিরে কাঁটাতার নির্মাণের সময়ও তারা আন্তর্জাতিক আইনকে উপেক্ষা করছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী দুই দেশের মধ্যকার ১৫০ মিটার এলাকায় কোনো স্থায়ী স্থাপনা (Structure) নির্মাণ সম্পূর্ণ অবৈধ হলেও ভারত সেটি মানছে না। সবচেয়ে অবাক করার মতো বিষয় হলো : বিরোধপূর্ণ মুহুরি নদী এলাকায় বাংলাদেশ সরকার ভারতকে মাঝ নদী বরাবর ‘জিরো’ পয়েন্টে বেড়া নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বর্তমান একতরফা অবস্থা এতটাই দৃষ্টিকটু ঠেকছে যে, সরকারপন্থী মিডিয়া পর্যন্ত মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছে।
বাংলাদেশের ইসলামীপন্থীদের আওয়ামী বলয়ে আকৃষ্ট করার মিশনে নিয়োজিত ‘দৈনিক ইনকিলাব’ পত্রিকায় ১৮ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রকাশিত ‘লিড স্টোরি’র শিরোনাম, ‘বাংলাদেশের জমি চলে যাচ্ছে ভারতের অংশে।’ সংবাদটির ‘ইন্ট্রো’ পাঠকদের জ্ঞাতার্থে উদ্ধৃত করছি, ‘সীমান্ত নদী ভাঙনে বাংলাদেশের জমি ভারতের অংশে চলে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে নদীমুখে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করে দ্রুততর করা হচ্ছে ভাঙন প্রক্রিয়া। ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির অপব্যাখ্যা দিয়ে ভারত এসব জমির নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে। আর এসব জমিতে নির্মাণ করা হচ্ছে বিভিন্ন স্থাপনা, দেয়া হচ্ছে কাঁটাতারের বেড়া।’ ২০০৮ সালের নির্বাচনে অর্থ প্রদানসহ নানা কিসিমের ভারতীয় সহায়তার ঋণ চুকাতে উদগ্রীব সরকারের বিগত তিন বছরের শাসনামলে বাংলাদেশের স্বার্থ পুরোপুরি উপেক্ষিত থেকেছে। কাজেই এদের আমলে সম্পাদিত কোনো চুক্তিই এ দেশের দেশপ্রেমিক নাগরিকের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
দক্ষিণ তালপট্টিতে ভারতীয় আগ্রাসনের বিষয় অবতারণা করে ড. মনমোহন সিংয়ের সাম্প্রতিক ঢাকা সফরের প্রেক্ষিতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের উপর রচিত মন্তব্য প্রতিবেদনের দ্বিতীয় কিস্তি শেষ করব। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার প্রশাসনিক এলাকার মধ্যে বঙ্গোপসাগরে দক্ষিণ তালপট্টি নামে যে ভূখণ্ডটি ক্রমেই জেগে উঠছে, সেটি র্যাডক্লিফ রোয়েদাদ অনুযায়ী বাংলাদেশের অংশ হলেও সামরিক শক্তির জোরে ভারত সেই ভূখণ্ডকে অপদখলে রেখেছে। র্যাডক্লিফ রোয়েদাদে ‘থলওয়েগ ডকট্রিন’ (Thalweg Doctrine) এর মিড-চ্যানেল ফ্লো (mid channel flow)’র নীতিমালার ভিত্তিতে নদী দ্বারা বিভক্ত সীমানায় ভূমির ওপর সার্বভৌমত্ব নির্ধারণের বিষয়টি সাব্যস্ত করা হয়েছে। হাড়িয়াভাঙ্গা (Hariabhanga) নদীতে সেই নীতি প্রয়োগ করলে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী দক্ষিণ তালপট্টি নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের ভূখণ্ড। মরহুম জিয়াউর রহমানের শাসনামলেই সর্বপ্রথম বাংলাদেশ দক্ষিণ তালপট্টির ওপর তার সার্বভৌমত্ব দাবি করে। কিন্তু ক্ষমতাশালী ভারতীয় নৌবাহিনী আমাদের কোনো নৌযানকেই ওই এলাকায় যেতে দিচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গ সরকার দক্ষিণ তালপট্টিকে ‘নিউ মুর দ্বীপ’ (ঘব িগড়ড়ত্ব ওংষধহফ) এবং পূর্বাশা নামে অভিহিত করে ভূখণ্ডটিকে তাদের বলে দাবি করছে। ১৯৮১ সালে ভারত সেখানে তাদের পতাকা ওড়ায় এবং একটি অস্থায়ী বিএসএফ ক্যাম্পও প্রতিষ্ঠা করে।
একবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে বিশ্ব উষ্ণায়নের (Global warming) প্রতিক্রিয়ায় দক্ষিণ তালপট্টি সম্পূর্ণভাবে বঙ্গোপসাগরের পানির নিচে চলে গেলেও এই অগভীর স্থানে ২৫ থেকে ৩০ বর্গ মাইল বিশিষ্ট ভূমি জেগে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের সীমানা নির্ধারণের সময় তত্কালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেনের নগ্ন পক্ষপাতিত্বের কারণে সিরিল র্যাডক্লিফ (Cyril Radcliff) সেই সময়কার ব্রিটিশশাসিত ভারত উপমহাদেশের যে সীমানা বিভাজন করেন, তাতে পাকিস্তান পরিষ্কারভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অথচ সেই র্যাডক্লিফের অনুসৃত পদ্ধতি অনুযায়ী দক্ষিণ তালপট্টি আয়তনে ক্ষুদ্র রাষ্ট্র বাংলাদেশের অংশ হলেও বিপুলাকায় ভারত আজ সেটি মানতে সম্মত নয়। ১৯৪৭ সাল থেকেই বাংলাদেশের ভূমিসহ অন্যান্য সম্পদের ওপর ভারতের আগ্রাসী তত্পরতার কখনই অবসান ঘটেনি। একই চিত্র আমরা বঙ্গোপসাগরের সমুদ্র সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রেও দেখতে পাচ্ছি। খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ অংশেও আমাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় বৃহত্ প্রতিবেশী ভারত বন্ধুসুলভ সহমর্মিতা ও সহযোগিতা প্রদর্শনের পরিবর্তে তাদের আধিপত্যবাদী চেহারাটাকেই স্বাধীনতাত্তোর চল্লিশ বছর ধরে দেখিয়ে এসেছে।
নিজস্ব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক স্বার্থে ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করার বিনিময়ে ভারতকে পুরো দেশটি ইজারা দেয়ার যে বন্দোবস্ত বাংলাদেশের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছে, তাকে পরাজিত করেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার প্রকৃত চেতনা’র প্রমাণ দিতে হবে। জনগণকে উপলব্ধি করতে হবে অতিমাত্রায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ফেরিওয়ালারাই বর্তমান সময়ের স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সাম্প্রতিক বক্তব্যের মধ্যেও বৃহত্ ভারতে বাংলাদেশের লীন হয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন ঘটেছে। পাকিস্তানপন্থী রাজাকারদের ১৯৭১-এ পরাজিত করার বিরোচিত ইতিহাস থেকেই বর্তমানের ভারতপন্থী রাজাকারদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রেরণা গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে দ্বিতীয় কিস্তি সমাপ্ত করছি।
মন্তব্য প্রতিবেদন : অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তি
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মোগল ভারতে বাণিজ্য করতে এসে এক সময় উপমহাদেশের মালিক বনে গিয়েছিল। তাদের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের প্রথম বলি আমরাই হয়েছিলাম। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি মীরজাফর এবং অন্যান্য সেনাপতি ক্ষমতার প্রলোভনে এবং ঘুষের বিনিময়ে বিশ্বাসঘাতকতা করলে পলাশীর প্রান্তরে ১৭৫৭ সালের চূড়ান্ত যুদ্ধে লর্ড ক্লাইভের নেতৃত্বে কোম্পানির বাহিনী অপ্রত্যাশিতভাবে জয়লাভ করে। দেশের স্বাধীনতা রক্ষার সেই যুদ্ধে মীরমদন এবং মোহনলাল অবশ্য ব্যতিক্রম ছিলেন। সেনাপতি মীরমদন যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হন। অপর দেশপ্রেমিক সেনাপতি মোহনলালের পরিণতি ইতিহাসের বই থেকে নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও নাটক, সিনেমায় তার ফাঁসি হয়েছিল বলেই দেখানো হয়ে থাকে। মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতামূলক তাবত্ কাজকর্মে সেই সময়কার বিত্তশালী ব্যবসায়ীরা মদত জুগিয়েছিলেন। সেই ব্যবসায়ীদের অন্যতম ছিলেন ধনকুবের আমির চাঁদ বা উমিচাঁদ এবং জগেশঠ। বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনার কাজে সহায়ক হবে মনে করেই তরুণ নবাব সিরাজের বেদনাবিধুর ইতিহাস নিয়ে আমার এই নাড়াচাড়া।
পলাশী যুদ্ধপরবর্তী ১৯০ বছরে প্রথমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং ১৮৫৭ সালের মহান সিপাহী বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ার পর ইংরেজ সরকার সরাসরি ভারতের শাসনভার গ্রহণ করে। এই বিশাল উপমহাদেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি দুই শতকে পর্যায়ক্রমে নানারকম কৌশল প্রয়োগ করেছিল। চারশ’ বছরব্যাপী মোগল সাম্রাজ্যের একেবারে শেষলগ্নে কেন্দ্রের দুর্বলতায় পলাশী যুদ্ধের আগেই উপমহাদেশ জুড়ে অনেক স্বাধীন রাজ্যের উত্থান ঘটেছিল। বাংলা করায়ত্ত করার পর এসব স্বাধীন রাজন্যবর্গকে পরাভূত করতে ব্রিটিশরা কখনও সরাসরি সামরিক শক্তি প্রয়োগ করেছে, আবার কখনও বা বন্ধুত্বের ছলনায় একে একে রাজ্যসমূহ কুক্ষিগত করেছে। মিত্রতার নামে রাজ্য অধিকারে লর্ড কর্নওয়ালিসের অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তির কৌশল ইতিহাসের সব ছাত্রেরই জানা। মহীশুরের হায়দর আলী এবং তার পুত্র টিপু সুলতান তাদের জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অবশ্য ব্রিটিশদের সব ষড়যন্ত্র ও অপকৌশলের বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়ে যান। যুদ্ধ করতে করতে ‘মহীশুরের ব্যাঘ্র’ নামে আখ্যায়িত মহাবীর ও নিখাদ দেশপ্রেমিক টিপু সুলতান শহীদ হলে মহীশুরও সাম্রাজ্যবাদীদের করায়ত্ত হয়। যুদ্ধক্ষেত্রেই টিপু সুলতানের নিষ্প্রাণ দেহ পড়ে ছিল।
সে আরেক বীরত্ব ও দেশপ্রেমের মহান অথচ ট্র্যাজিক কাহিনী। বিশ্ব ইতিহাসে বীরত্বের অধিকাংশ কাহিনীই বোধহয় ট্র্যাজেডিতে শেষ হয়েছে। মহীশুরের ক্ষেত্রেও ইংরেজরা শঠতা ও বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় নিয়েছিল। টিপু সুলতান যখন সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে একাকী লড়ছেন, সেই মুহূর্তে নিজাম, পেশোয়া এবং মারাঠারা ইংরেজদের তল্পিবাহক হয়ে উচ্ছিষ্ট ঘরে তুলতে ব্যস্ত থেকেছে।
যাক সেসব কথা। ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সম্প্রসারণকালে ব্যবহৃত ‘Protectorate’ শব্দটি বর্তমানের শেখ হাসিনার বাংলাদেশে প্রাসঙ্গিক বলেই এত পুরনো কথার অবতারণা করলাম। আন্তর্জাতিক আইনে এই ইংরেজি ঢ়ত্ড়ঃবপঃড়ত্ধঃব শব্দটির আধুনিক যুগের সংজ্ঞা পাঠকের জ্ঞাতার্থে উদ্ধৃত করছি,
"It is an autonomous territory that is protected diplomatically or militarily against third parties by a stronger state. In exchange for this, the protectorate usually accepts specific obligations. However, it retains some measure of sovereignty."
(এটি এমন একটি ভূখণ্ড যা অপর একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র কর্তৃক কূটনৈতিক ও সামরিক নিরাপত্তা প্রদত্ত। এই নিরাপত্তা প্রদানের বিনিময়ে আশ্রিত রাষ্ট্রের কিছু দায়বদ্ধতা থাকে। যাই হোক, এই প্রকার ভূখণ্ডের খানিকটা সার্বভৌমত্ব রয়েছে) ঔপনিবেশিক আমলের ‘Colonial Protectorate’-এর ক্ষেত্রে অবশ্য আশ্রিত রাষ্ট্রের কোনোরকম সার্বভৌমত্বের বালাই ছিল না। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি Protectorate-এর দুই সংজ্ঞার মধ্যে বর্তমানে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, সেই বিষয় নিয়ে বিতর্ক উসকে দেয়ার উদ্দেশ্যেই আমার আজকের এই লেখা।
বাংলাদেশের চিন্তাশীল ও প্রকৃত স্বাধীনতাকামী নাগরিকদের কাছে ক্রমেই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, লাখ লাখ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে প্রাপ্ত স্বাধীন ভূখণ্ডটিকে ভারতের protectorate-এ পরিণত করার আকাঙ্ক্ষাতেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সে দেশের শাসকশ্রেণী সহায়তা প্রদান করেছিল। ইন্দিরা গান্ধীর মহত্ত্ব প্রদর্শন কিংবা বাংলাদেশের অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো ছিল সম্পূর্ণ গৌণ বিষয়। ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয়ে লেখা গত দুই কিস্তির মন্তব্য প্রতিবেদনে বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ উদ্ধৃত করে ভারতের গুপ্ত বাসনার কথা যথাসাধ্য প্রকাশ করার চেষ্টা করেছি। আজকের শেষ কিস্তিতে গত চল্লিশ বছরে দুই দেশের মধ্যে সম্পাদিত রাজনৈতিক চুক্তিগুলো নিয়ে খানিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের চেষ্টা করব।
১৯৭২ সালের মার্চে স্বাক্ষরিত বাণিজ্য চুক্তি এবং প্রথম নৌ-ট্রানজিট চুক্তি, ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি এবং ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রতারণা করে ফারাক্কা বাঁধ চালুর সব প্রাসঙ্গিক দলিল গত দুই বুধবারে উপস্থাপন করেছি। আজ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকালীন প্রণীত Framework Agreement নিয়েই মূলত আলোচনার ইচ্ছে থাকলেও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ধারাবাহিকতার বিষয়টি তুলে ধরার জন্য আবারও ১৯৭২ সালে ফিরে যেতে হচ্ছে। সে বছর ঢাকায় ইন্দিরা গান্ধীর সফরকালে ১৯ মার্চ Treaty of friendship, Cooperation and peace between the Republic of India and the People's Republic of Bangladesh নামক বিতর্কিত পঁচিশ বছর মেয়াদি চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তিতেই ভারতীয় সংবিধানের আদলে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ঝবপঁষধত্রংস আমদানি করা হয়, যদিও এ দেশের ভারতপন্থী বুদ্ধিজীবীকুল ও সুশীল (?) সমাজ দীর্ঘদিন ধরে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এ দেশে Secularism প্রতিষ্ঠা ও বিসমিল্লাহর বিরুদ্ধে করা হয়েছিল বলে সর্বৈব মিথ্যা ও ইসলাম ধর্মবিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছেন। বারোটি অনুচ্ছেদবিশিষ্ট পঁচিশ বছর মেয়াদি চুক্তিটি বাংলাদেশকে প্রকারান্তরে ভারতের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত করার অসত্ উদ্দেশ্যে যে সম্পাদিত হয়েছিল, সেটি নিচে উদ্ধৃত অনুচ্ছেদ ৪, ৯ এবং ১০ থেকেই প্রমাণিত : 
Article 4 : "The High Contracting Parties shall maintain regular contacts with each other on major international problems affecting the interests of both States, through meetings and exchange of views at all levels."
(চুক্তিবদ্ধ পক্ষদ্বয় তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সমস্যা প্রসঙ্গে সকল পর্যায়ে সভা ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করবে।)
Article 9 : "Each of the High Contracting Parties shall refrain from giving any assistance to any third party taking part in and armed conflict against the other party. In case either party is attacked or threatened with attack, the High Contracting Parties shall immediately enter into mutual consultations in order to take appropriate effective measures to eliminate the threat and thus ensure the peace and security of their countries."
(চুক্তিবদ্ধ পক্ষদ্বয় কোনো তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত হলে কোনো পক্ষই সেই তৃতীয় পক্ষকে কোনোরূপ সহায়তা প্রদান করবে না। যে কোনো পক্ষ আক্রান্ত হলে অথবা হুমকির সম্মুখীন হলে সেই আক্রমণ অথবা হুমকি মোকাবেলা করে শান্তি স্থাপন ও নিরাপত্তা বিধানে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার লক্ষ্যে চুক্তিবদ্ধ পক্ষদ্বয় জরুরি আলোচনায় মিলিত হবে।)
Article 10 : "Each of the High Contracting Parties solemnly declares that it shall not undertake any commitments, Secret or open, toward one or more States which may be incompatible with the present Treaty."
(চুক্তিবদ্ধ পক্ষদ্বয় এই মর্মে ঘোষণা দিচ্ছে যে, তারা অন্য কোনো এক বা একাধিক রাষ্ট্রের সঙ্গে গোপন অথবা প্রকাশ্য এমন কোনো প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হবে না যা এই চুক্তির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে।)
উপরিউক্ত চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের আধিপত্যের কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করেন এবং বিশেষত অনুচ্ছেদ ১০-এ সম্মত হয়ে তিনি তৃতীয় দেশের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপনের সুযোগও রহিত করেন। ভারতের সঙ্গে ২৫ বছর মেয়াদি এই চুক্তির কারণেই চীন ও সৌদিআরবসহ বহু রাষ্ট্র বাংলাদেশকে সেই সময় স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে। একাধিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক অবশ্য দাবি করে থাকেন যে, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে ভারতেই ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ভারত-পাকিস্তান চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরুর আগেই অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ শেষে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর ঢাকায় ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ১৯ মার্চ যে চুক্তি স্বাক্ষর করেন, সেটি আগেকার বশ্যতা স্বীকারের এক প্রকার আনুষ্ঠানিকতা ছিল মাত্র। বাংলাদেশের জন্য অসম্মানজনক চুক্তি চাপিয়ে দেয়া হলেও দিল্লি কিন্তু তার সুবিধামত চুক্তির শর্ত ভাঙতে কোনো দিনই দ্বিধা করেনি।
চুক্তির ৮ নম্বর অনুচ্ছেদে কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিবাদে কোনো বিদ্রোহী পক্ষকে সহায়তা না করার সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও ভারত অবলীলায় চুক্তি ভঙ্গ করে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী এবং তথাকথিত শান্তি বাহিনীকে অস্ত্র, প্রশিক্ষণ, অর্থ এবং অন্যান্য সহায়তা দিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ পরিচালনায় সরাসরি অংশগ্রহণ করছে। ভারত সরকার সে দেশের ভূখণ্ডকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে ব্যবহৃত হতে দিয়ে চুক্তির ৮ অনুচ্ছেদের নিম্নোক্ত অংশ বছরের পর বছর ধরে পরিষ্কারভাবে লঙ্ঘন করেছে,
"Each of the High Contracting parties shall refrain from any aggression against the other party and shall not allow the use of its territory of committing any act that may cause military damage to or constitute a threat to the security of the other High Contracting Party."
(চুক্তিবদ্ধ পক্ষ একে অপরের বিরুদ্ধে সর্বপ্রকার আগ্রাসী তত্পরতা থেকে বিরত থাকবে এবং নিজের ভূখণ্ড অন্য পক্ষের সামরিক ক্ষয়ক্ষতি কিংবা তার নিরাপত্তার বিরুদ্ধে হুমকি সৃষ্টিকারী কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হতে দেবে না।)
বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর কাদের সিদ্দিকী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং ভারত সরকারের সহায়তাক্রমে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষিপ্ত যুদ্ধে লিপ্ত হন। ইন্দিরা গান্ধী পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলে মোরারজী দেশাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন এবং তিনি বাংলাদেশ বিরোধী এই অপতত্পরতায় শেষ অবধি ইতি টানেন। অপরদিকে প্রায় দুই যুগ ধরে সন্তু লারমার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বিশেষত চাকমারা ভারতে ক্যাম্প স্থাপন করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই অব্যাহত রাখে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার প্রথম দফা ক্ষমতা গ্রহণের প্রেক্ষাপটে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে দীর্ঘ দুই যুগব্যাপী সেই বিদ্রোহের অবসান ঘটে। আজকের বাংলাদেশে চট্টগ্রামের চাঞ্চল্যকর দশ ট্রাক অস্ত্র মামলাকে কেন্দ্র করে জাতীয় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার দু’জন সাবেক মহাপরিচালককে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছে। অভিযোগ করা হচ্ছে, তারা নাকি চীন থেকে পাঠানো এই অস্ত্রের চালান বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের আসাম রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী উলফাকে (ULFA) হস্তান্তরের কাজে সহায়তা করেছিলেন। অভিযোগ যদি সত্য হয়ে থাকে এবং সেই কারণে বর্তমান সরকার যদি দুই সাবেক জেনারেলকে অপরাধী বিবেচনা করেন, তাহলে নৈতিকতার মানদণ্ডেই কাদের সিদ্দিকী এবং সন্তু লারমাকে অস্ত্র সরবরাহকারী ও প্রশিক্ষণদানকারী ভারতীয় জেনারেলদের বিচারও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ভারতের কাছে দাবি করা উচিত। ভারতীয় জেনারেলদের বিচারের বিষয়টি প্রসঙ্গক্রমে এসেছে এবং এটি আজকের মন্তব্য প্রতিবেদনের মূল বিষয় নয় বিধায় এই লেখায় সে সম্পর্কে বিশদ আলোচনায় আর যাচ্ছি না। এ বিষয়ে ভবিষ্যতে লেখার ইচ্ছা রইল।
মুজিব-ইন্দিরা স্বাক্ষরিত ২৫ বছর মেয়াদি তথাকথিত Treaty of Friendship চুক্তির আলোকে এবার সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখে মুজিব তনয়ার সই করা Framework Agreement নিয়ে আলোচনা করা যাক। কাকতালীয়ভাবে এবারের চুক্তিটিও পূর্ববত্ বারোটি ধারাসংবলিত এবং চুক্তি স্বাক্ষরের স্থানও সেই ঢাকাতেই। চুক্তির প্রথম ধারাতেই বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে আধিপত্যবাদী ভারতের জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে করিডোর নেয়ার আয়োজন পাকাপোক্ত করা হয়েছে,
"........... facilitate trade, by road, rail, inland waterways, air and shipping. Both parties will encourage the development of appropriate infrastructure, use of sea ports, multi-modal transportation and standardization of means of transport for bilateral as well as sub-regional use."
(...রাস্তা, রেল, অভ্যন্তরীণ নদীপথ, আকাশপথ এবং জাহাজযোগে বাণিজ্যে সহায়তা প্রদান। যথাযথ অবকাঠামো নির্মাণ, সমুদ্র বন্দর ব্যবহার, বিভিন্ন প্রকার পরিবহন ব্যবস্থা ও যানবাহনের মধ্যে এক প্রকার সমমানদণ্ড বিধানের জন্য উভয়পক্ষ উত্সাহিত করবে যাতে সেগুলোর দ্বিপাক্ষিক এবং উপ-আঞ্চলিক ব্যবহার সম্ভব হয়।)
পাঠক, একটু মনোযোগ দিয়ে পড়লেই বুঝতে সক্ষম হবেন যে ধারাটি কেবল ভারতের স্বার্থ পূরণে প্রণীত হয়েছে। এই একতরফা ধারা বাংলাদেশের জনগণকে বিভ্রান্ত করে জায়েজ করার অপকৌশল হিসেবেই অনর্থক উপ-অঞ্চলকে কোনোরূপ সংজ্ঞায়িত না করেই টেনে আনা হয়েছে। এখানে দক্ষিণ এশিয়া, সার্ক কিংবা এই অঞ্চলের অন্য রাষ্ট্রগুলোর নাম নির্দিষ্ট না করে কেবল উপ-অঞ্চল বলার অর্থই হচ্ছে পরবর্তীকালে বড়জোর নেপাল ও ভুটানকে চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অথবা সামরিক, কোনো বিবেচনাতেই কেবল নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে আমাদের এই প্রকার সংযোগ স্থাপনের তেমন কোনো মূল্য নেই। অর্থাত্ চুক্তিতে ব্যবহৃত ভাষাগত দুর্বোধ্যতা (Jargon) ও অস্বচ্ছতার মাধ্যমে ভারতের করিডোর পাওয়াটাই মূল উদ্দেশ্য। চুক্তির সাত নম্বর অনুচ্ছেদে 'physical connectivity' অর্থাত্ প্রাকৃতিক সংযোগের বিষয় উল্লেখ করে আবার প্রচ্ছন্নভাবে সেই ভারতীয় করিডোরকেই সামনে নিয়ে আসা হয়েছে।
মুজিব-ইন্দিরার অতীব বিতর্কিত পঁচিশ বছর মেয়াদি চুক্তির চেয়েও অধিকতর নগ্নভাবে যে এইবার বাংলাদেশকে দিল্লির অধীনস্থ করে ফেলা হয়েছে সেটি চুক্তির ৮, ৯, ১০ এবং ১১ নম্বর ধারাতেই প্রমাণিত। পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে চারটি ধারাই আমি এখানে উদ্ধৃত করছি,
Article 8 : "To cooperate closely on issues relating to their national interests, Both parties shall work together to create a peaceful environment conducive for inclusive economic growth and development."
(উভয় রাষ্ট্র পরিবেষ্টক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ প্রতিষ্ঠায় জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করবে।)
Article 9 : "To cooperate on security issues of concern to each other while fully respecting each other's sovereignty. Neither party shall allow the use of its territory for activities harmful to the other."
(পরস্পরের সার্বভৌমত্বের প্রতি পরিপূর্ণভাবে শ্রদ্ধাশীল থেকে নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট উদ্বেগের বিষয়ে সহযোগিতা করবে। কোনো দেশই তার ভূখণ্ডকে অন্য দেশের জন্য ক্ষতিকারক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য ব্যবহৃত হতে দেবে না।)
Article 10 : "To establish a joint Consultative Commission for effective and smooth implementation of this Agreement that shall meet once a year."
(চুক্তির কার্যকর ও স্বচ্ছন্দ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠিত যৌথ পরামর্শক কমিটি বছরে অন্তত একবার সভা অনুষ্ঠান করবে।)
Article 11 : "The Agreement may be amended by mutual consent in order to enhance, deepen and widen the scope of cooperation, including regional/sub-regional expansion."
(সহযোগিতার পরিধিকে বিস্তৃত এবং গভীরতর করার লক্ষ্যে এই চুক্তি পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে এমনভাবে সংশোধন করা যাবে যাতে করে চুক্তির আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সম্প্রসারণ সম্ভব হয়।)
বর্তমান ভারতবান্ধব সরকারের আমলে বাংলাদেশকে দিল্লির নিয়ন্ত্রণাধীন করার পর ভবিষ্যতের কোনো দেশপ্রেমিক সরকার যাতে আমাদের মাতৃভূমিকে শৃঙ্খলমুক্ত না করতে পারে, সেই উদ্দেশ্য সাধনে অত্যন্ত আপত্তিকর ১২ নং ধারা প্রণীত হয়েছে। শাসক গোষ্ঠীর মধ্যে দেশপ্রেমের লেশমাত্র থাকলে তারা এই ধারাটি অন্তত মানতে পারতেন না। ধারাটিতে বলা হয়েছে,
"This Agreement shall come into force on the date of its signing by the two parties and shall remain in force until terminated by mutual consent in accordance with Para 2 of this Article.
Either Party may seek termination of this Agreement by giving a written notice to the other Party providing the reasons for seeking such termination. Before this Agreement is terminated, the Parties shall consider the relevant circumstances and hold consultations to address the reasons cited by the Party seeking termination in the Joint Consultative Commission."
(উভয়পক্ষ কর্তৃক চুক্তি স্বাক্ষরের দিন থেকে চুক্তি কার্যকর হবে এবং এই অনুচ্ছেদের ২য় অংশে বর্ণিত পন্থা অনুযায়ী পারস্পরিক সম্মতিতে অবসান করার পূর্ব পর্যন্ত চুক্তি বলবত্ থাকবে।
যে কোনো পক্ষ সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখপূর্বক চুক্তি বাতিলের জন্য লিখিত নোটিশ দিতে পারবে। চুক্তি বাতিলের আগে পক্ষদ্বয় প্রাসঙ্গিক পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করবে এবং যৌথ পরামর্শক কমিটি চুক্তি বাতিলের কারণ পর্যালোচনাপূর্বক তার সমাধানের প্রচেষ্টায় আলোচনা করবে।)
এখানেই শেষ নয়। শেখ হাসিনা জাতীয় স্বার্থবিরোধী যে ভয়ঙ্কর চুক্তি ষোল কোটি জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন সেই চুক্তির অধীনে একবার কোনো ব্যবস্থা অথবা কার্যক্রম গৃহীত হলে সেটি চুক্তি বাতিল হলেও রহিত করা যাবে না। চুক্তির শেষাংশটি নিম্নরূপ—
"Actions taken or agreements reached pursuant to this Agreement shall not be affected by its expiry or termination."
(অত্র চুক্তির অধীন কোনো কার্যক্রম গৃহীত হলে অথবা কোনো চুক্তিতে উপনীত হলে সেটি বর্তমান চুক্তির মেয়াদ অতিক্রম অথবা চুক্তি অবসান হওয়া দ্বারা প্রভাবিত হবে না।)
আশা করি, নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা চুক্তির উপরিউক্ত অংশটি নিয়ে তাদের লেখালেখি এবং বক্তব্য-বিবৃতিতে বিশদভাবে আলোচনা করবেন। তবে, আমি এখানে চিরস্থায়ী পরাধীনতারই সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাচ্ছি। ধরা যাক, নিরাপত্তার অজুহাতে ভারত চুক্তি বলবত্কালীন বাংলাদেশে একটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করল। তারপর ভবিষ্যতে দেশে স্বাধীনতার প্রকৃত চেতনায় বিশ্বাসী কোনো সরকার ক্ষমতাসীন হয়ে Framework Agreement বাতিল করল। তখন আমরা কি সেই সামরিক ঘাঁটি সরাতে বৃহত্ প্রতিবেশীকে বাধ্য করতে পারব? নাকি ভারত চুক্তির শেষাংশের অজুহাতে আমাদের দাবি মানতে অস্বীকার করবে? সে রকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের নাগরিকদের ১৯৭১ সালের মতো আবারও কি সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নিতে হবে?
ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের ঠিক ২৪ ঘণ্টা আগে জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় আমি মন্তব্য করেছিলাম যে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে Framework Agreement স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশ তার ‘প্রকৃত স্বাধীনতা’ হারাবে। আমার সেই মন্তব্যে ভারতপন্থী বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকগোষ্ঠী অতিশয় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। আওয়ামী ঘরানার এক ব্যাংকার বুদ্ধিজীবী ও বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান আমার সেই মন্তব্যে কুপিত হয়ে ‘কালের কণ্ঠ’ পত্রিকায় তার কলামে আমার নাম উল্লেখ না করে কঠোর সমালোচনা করেছেন। পাঠকদের স্মরণে থাকার কথা যে, এই ব্যক্তিটি বর্তমান সরকার কর্তৃক শেয়ারবাজার কারসাজির উপর গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান রূপে নিযুক্তি লাভ করে যে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছিলেন, সেটিকে দেশের অধিকাংশ অর্থনীতিবিষয়ক বোদ্ধামহল জঞ্জাল রূপেই বিবেচনা করেছিলেন। সেই ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ মার্কা রিপোর্ট দ্বারা না কোনো অপরাধী শনাক্ত করা গেছে, না ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা লাভবান হয়েছেন। ভারতের প্রতি নতমস্তক এই প্রকৃতির দলবাজ ব্যক্তি আমার প্রতি বিরূপ মন্তব্য করায় আমি বরঞ্চ সন্তোষই বোধ করেছি।
বাংলাদেশের এই গোষ্ঠীভুক্তরা দেশ বিক্রি কিংবা স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করলে সর্বদাই ঠাট্টা-তামাশা করেছেন, বিদ্রূপ করে ভারতীয় জুজুর ভয় দেখানোর কথা বলেছেন। আজ প্রকৃত স্বাধীনতা হরণ হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে দেশপ্রেমিক জনগণ অবশ্যই জানার অধিকার রাখেন যে, এসব বুদ্ধিজীবী কী জেনেশুনে, বিশেষ উদ্দেশ্যে ওইসব মন্তব্য করতেন, নাকি ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী নীতি সম্পর্কে তারা প্রকৃতই অজ্ঞ ছিলেন? যদি জেনেশুনে তারা জনগণকে বিভ্রান্ত করে থাকেন, তবে অবশ্যই দেশদ্রোহিতার অভিযোগে তাদের বিচারের দাবি ওঠা উচিত। আর অজ্ঞতার কারণে এই ভুল করে থাকলে জাতির কাছে করজোড়ে ক্ষমা ভিক্ষা করা আবশ্যক। 
ভারতপন্থী আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা সত্যকে স্বীকার না করলেও আমি নিশ্চিত মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনায় বিশ্বাসী এ দেশের প্রতিজন স্বাধীনতাকামী নাগরিক ধর্ম, বর্ণ, দল ও মতকে অতিক্রম করে সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখে ঢাকায় স্বাক্ষরিত হাসিনা-মনমোহন চুক্তিকে নির্দ্বিধায় প্রত্যাখ্যান করবেন। ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষ তিস্তার পানি না পেলেও অথবা ভারত ও বাংলাদেশের ছিটমহলবাসীদের দীর্ঘ ৬৪ বছরের বঞ্চনার অবসান না হলেও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী কিন্তু ঠিকই আমাদের রাষ্ট্রটিকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির মতো করেই অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তিতে আবদ্ধ করে গেছেন। আমাদের মাতৃভূমিকে আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত করার অপকর্মের জন্য বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির আত্মা বর্তমান শাসকগোষ্ঠীকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারে না। আসুন, আমরা মহাবীর টিপু সুলতানের বীরত্ব ও স্বাধীনতার চেতনা হৃদয়ে ধারণ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে প্রয়োজনে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে প্রস্তুত হই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন