শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১১

বাংলাদেশ-ভারতের অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন সংকটের সমাধান কী


ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদী আছে। এর মধ্যে দুই-তিনটি ছাড়া বাকি সব নদী ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। খুব ছোট দুই-তিনটি নদী বাংলাদেশ থেকে ভারতে যায়, এই নদীগুলোকে সহজেই তিন ভাগে ভাগ করতে পারি। বড় নদী, যে ভাগে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রকে ফেলতে পারি। গঙ্গা নদী বাংলাদেশে ঢুকে পদ্মা নাম নেয়। আর ব্রহ্মপুত্র বাহাদুরাবাদের কাছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র আর যমুনা এই দু’শাখায় প্রবাহিত হয়। যমুনা শাখা, গঙ্গা তথা পদ্মার সঙ্গে মিশে আরিচার পরে যে ধারায় প্রবাহিত হয় সেটাকেও আমরা পদ্মা বলি। আমি গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র আর পদ্মা এ তিনটিকে আলাদা করে দেখব এই কারণে যে, গঙ্গার প্রবাহ ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিলিত হয়ে পদ্মার প্রবাহের সৃষ্টি করে। এ দুটি নদী ছাড়া আরেকটি বড় নদী হচ্ছে ভারতের বরাকÑ যে নদীটি বাংলাদেশের সীমানায় এসে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে সুরমা এবং কুশিয়ারা নামে প্রবাহিত হয় এবং ভৈরবের কাছে এ দুই প্রবাহ মিলিত হয়ে আপার মেঘনা বা মেঘনা নামে প্রবাহিত হয়, চাঁদপুরের কাছে পদ্মার সঙ্গে মিলিত হওয়ার পরে নিচের অংশটিও মেঘনা নামেই পরিচিত হয়Ñ আমরা চাঁদপুরের উপরের অংশটাকে আপার মেঘনা আর চাঁদপুরের নিচের অংশটাকে লোয়ার মেঘনা বলে থাকি। কারণ আপার মেঘনার প্রবাহের সঙ্গে লোয়ার মেঘনার বিরাট তফাৎ। কারণ ইতিমধ্যে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি এসে পদ্মার সঙ্গে মিলিত হয়ে তারপর লোয়ার মেঘনা হয়েছে।
অর্থাৎ তিনটি নদীরÑ নদীগুলোর প্রবাহকে আলাদা করে বোঝার জন্য আমরা এই নামগুলো ব্যবহার করি। বাকি নদীগুলোর মধ্যে মাঝারি নদী যদি বলি, এর মধ্যে আসবে তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, মনু, মুহুরি, খোয়াই, গোমতীÑ এই সাত-আটটি নদী। এর পরেও যে নদীগুলো আছে, যেমনÑ ইছামতি, কোদালিয়া, মাথাভাঙ্গা, কিংবা নিতাই, ভোগাই, সোমেশ্বরীÑ এগুলোও মাঝারি আকৃতির নদী। এর বাইরে যেসব নদী অভিন্ন নদী হিসেবে চিহ্নিত আছে, সেগুলো ছোট নদী। কিন্তু একটা কথা মনে রাখতে হবে, প্রতিটি নদীর অববাহিকা এলাকাতে ওই নদীটি ওই এলাকার পুরো পানি সরবরাহ করে। কিংবা ওই এলাকার পানি ব্যবস্থাপনায় এর ভূমিকা অপরিসীম। যেমন আখাউড়ার পাশ দিয়ে যে হাওড়া নদী গেছে, সেটি ওই এলাকার পুরো ভাগ্য নির্ধারণ করে।
ধীরে ধীরে আমাদের প্রতিটি নদীর উপরে একটা যৌথ ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। আমি প্রথমেই যৌথ ব্যবস্থাপনা শব্দটির ওপর নজর দিতে চাই। আমি বিশ্বাস করি এবং আন্তর্জাতিক মহলে বলা হয় যে, নদীর পানির ব্যবস্থাপনাটা হবে অববাহিকাভিত্তিক। অববাহিকার শুরু থেকে অর্থাৎ পাহাড়ের মাথা থেকে সমুদ্র পর্যন্ত যেখানে নদীটা পৌঁছেছে অথবা অন্য কোন নদীর সঙ্গে যেখানে মিলিত হয়েছেÑ এই অংশটুকুর দৈর্ঘ্যে নদীটি যে পরিমাণ এলাকার পানি পরিবহন করে থাকে, সেটাকে তার অববাহিকা বলছি। অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ স্বাভাবিকভাবে একটা অসম অবস্থাতে আছে। প্রতিটির ক্ষেত্রেই আমরা ভাটির দেশ। উজানে পানি কিভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করছে আমাদের ভাগ্য। একটা নদী যখন একটা দেশের দু’প্রদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয় তখনও চাপ সৃষ্টি হতে পারে, কারণ এক প্রদেশ অন্য প্রদেশের সঙ্গে সহযোগিতা করতে চাচ্ছে না। আর প্রদেশ দুটি যদি একটা ফেডারেল সরকারের দুটি রাজ্য হয়, তাহলে বিশাল জটিলতার সৃষ্টি হয়। যেটা আমরা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্টেটের মধ্যে দেখে থাকি। অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন স্টেটের মধ্যে এবং ভারতের রাজ্যগুলোর মধ্যে এ ধরনের দ্বন্দ্ব দেখতে পাই। গঙ্গার পানির কথা ধরা যাক। উত্তরাঞ্চল, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, হিমাচল প্রদেশসহ বিভিন্ন প্রদেশের মধ্য দিয়ে পানি বিহারে প্রবেশ করে; শুকনো মৌসুমে তার অধিকাংশই উজানে তুলে নেয়া হয়েছে। বিহার পার হয়ে পানি যখন পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করল সেখানে আরও তলানির পানির প্রাপ্তি ঘটে। বিহার এবং উত্তর প্রদেশ যে পরিমাণ প্রত্যাহার করল; তারা কি পশ্চিমবঙ্গে জন্য চিন্তা করেছে? মোটেই না।
গঙ্গার প্রবাহ যখন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, বাংলাদেশে প্রবেশ করছে তখন স্বাভাবিকভাবেই উজানের দেশের রাজধানী অর্থাৎ দিল্লির সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনা জটিলরূপে দেখা দেয়। কারণ পানি ব্যবস্থাপনা হল প্রদেশের বিষয় এবং এজন্য কেন্দ্রকে নিজের দেশের প্রদেশের সঙ্গেও দরকষাকষি করতে হয়। এজন্যই কার্যত নদীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিবেচনায় এনে পরিকল্পনা করা হলে বিহার কিংবা পশ্চিমবঙ্গের যে সমস্যা এবং বাংলাদেশের যে সমস্যা সেটা বহুলাংশে দূর করা সম্ভব হবে। কারণ একটি নদী সারাবছরই একই পরিমাণ পানি বহন করে না। বর্ষা মৌসুমে তার পানির প্রবাহের পরিমাণ অনেক বেশি। আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে গঙ্গা দিয়ে হয়তো ১৫ লাখ ঘনফুট পানি প্রতি সেকেন্ডে প্রবাহিত হচ্ছে; ব্রহ্মপুত্র দিয়েও হয়তো একই পরিমাণ কিংবা তার কাছাকাছি প্রবাহিত হচ্ছে। শুকনো মৌসুমে ব্রহ্মপুত্রের পানি নেমে আসবে দেড় লাখ কিউসেকে। গঙ্গার পানির উজানে যদি কোন পানি প্রত্যাহার করা না হতো, তাহলে তা হয়তো ওই রকম একটা পরিমাণে নেমে আসত। কিন্তু এখন সেটা পঞ্চাশ-ষাট হাজার কিউসেকে নেমে আসে। কারণ উজান থেকে পানি প্রত্যাহার করে নেয়া হচ্ছে সেচসহ বিভিন্ন কারণে। অর্থাৎ ভাটিতে যে পানির চাহিদা আছে উজান তা কিছুতেই মনে রাখতে চায় না। কাজেই আমরা যদি বর্ষার পানি পাহাড়ি অঞ্চলে ধরে রেখে শুকনো মৌসুমে প্রবাহ প্রবৃদ্ধি করতে পারি তাহলে এটা কারিগরিভাবে সমস্যার সমাধান হতে পারে।
উজানে পানি ধরে রাখলে যে বিরাট জলাধার সৃষ্টি হবে সেটি সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করে। উজানের যেসব অঞ্চল পানিতে ডুবে যাবে স্বাভাবিকভাবেই সেখান থেকে বহু মানুষকে উৎখাত হতে হয়। তাদের পুরোপুরি পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করলে মারাÍক সামাজিক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। আমরা বাংলাদেশের ভেতরেই কাপ্তাই ড্যামের কারণে চাকমাদের যে উৎখাত করা হয়েছিল তার সামাজিক প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করেছি। কাজেই এই জলাধারটি নির্মাণ করতে হবে এমনভাবে যাতে সামাজিক সমস্যাটা ন্যূনতম পর্যায়ে থাকে এবং যারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তাদের সঠিকভাবে পুনর্বাসিত করা হয়। এভাবে যদি জলাধার এবং বিদ্যুৎ নির্মাণ করে অববাহিকাভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারি তাহলে নদীটির সারা বছরে একটা সুষম ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব।
সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে সফরের পর দু’দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে যে যৌথ স্টেটমেন্ট স্বাক্ষরিত হয় তার ৫৮ নম্বর অনুচ্ছেদে আমি মনে করি একটি চমৎকার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, দু’দেশÑ আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক পর্যায়ে বিদ্যুৎ, পানিসম্পদ, যোগাযোগ ব্যবস্থা ইত্যাদির ক্ষেত্রে সম্পদের আহরণের ব্যবস্থাটা এমনভাবে নেবে যাতে করে দু’দেশেরই খাদ্য নিরাপত্তা, শিক্ষাব্যবস্থা, পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে উপকার হয়। তারা দু’পক্ষের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে করে বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতায় পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং পানিবিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে যৌথ প্রকল্প হাতে নেয়া যায়।
আমার মনে হয় এই সিদ্ধান্তটি দু’দেশের পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার সব বিরোধিতাকে পরিবর্তিত করে এটাকে সহযোগিতার ক্ষেত্র হিসেবে তৈরি করতে পারে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বক্তৃতায় এ কথাটির প্রতিধ্বনি তুলেছেন যে, পানিসম্পদের ব্যবস্থাপনাটা বিরোধের পরিবর্তে সহযোগিতার ক্ষেত্রে পরিণত হোক। এটি হতে হয়তো সময় লাগবে। সমীক্ষা হতে সময় লাগবে; যৌথ প্রকল্প হতে সময় লাগবে, দু’দেশের মধ্যে সহযোগিতার ক্ষেত্রে যে বিশ্বাস স্থাপন করা প্রয়োজন সেটি সময়সাপেক্ষ। তবে, প্রথমেই বর্তমানে প্রবাহ যে অবস্থায় আছে তার ভিত্তিতে অভিন্ন সব নদীর মধ্যে একটা ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। যে নদীগুলোতে ভারত ও বাংলাদেশের অবকাঠামো রয়েছে, সেগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়ে আসতে হবে। গোমতী কিংবা খোয়াই কিংবা তিস্তাতে উজানে অবকাঠামো আছে। এগুলোতে যে পরিমাণ পানি বর্তমানে শুকনো মৌসুমে আসছে তার ভিত্তিতেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে পরস্পরের শেয়ার চূড়ান্ত করতে হবে। আর দু’দেশের প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আঞ্চলিক ও উপাঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে পানিসম্পদের যৌথ ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারলে পানিবিদ্যুৎ তো উৎপাদিত হবেই, শুকনো মৌসুমে পানির প্রবাহটাও বেড়ে যাবে।
পানিবিদ্যুতের কথা যদি আমরা বলি তাহলে আমার মনে হয় যে আসাম কিংবা অরুণাচলে এক লাখ কিংবা তার চেয়ে বেশি মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। ওই অংশে ভারতের সেই পরিমাণ বিদ্যুতের চাহিদা নেই। ভারত স্বাভাবিকভাবেই চাইবে এই বিদ্যুৎকে ভারতের মধ্য অংশে নিয়ে যেতে এবং তার জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতার প্রয়োজন হবে। আমি লক্ষ্য করছি যে, বাংলাদেশ সম্প্রতি এ কাজটি সুচারুভাবে সম্পন্ন করার জন্য দেশের ভেতরে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ২৩০ কেভি থেকে উন্নীত করে ৪০০ কেভিতে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। আমি এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছি।
আমাদের আঞ্চলিক ক্ষেত্রে সহযোগিতার আরও একটি বিরাট ক্ষেত্র আছে। সেটি হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং আমি বিশেষ করে নৌব্যবস্থাপনার কথা বলব। আমরা ব্রিটিশ শাসনামলে দেখেছি আসাম থেকে সহজেই একটি বড় স্টিমার কলকাতা চলে যেত। তখন নদী রক্ষণাবেক্ষণ হতো। নদী এখন রক্ষণাবেক্ষণ না করার কারণে এ নদীগুলো নাব্যতা হারিয়েছে। পদ্মা দিয়ে জাহাজ, স্টিমার, ফারাক্কা হয়ে অনেক উজানে চলে যেতে পারত। কাজেই নদীর নাব্যতা ফেরত আনা প্রয়োজন। ভবিষ্যতের সম্ভাবনার মধ্যে পানি ব্যবস্থাপনা, নৌব্যবস্থাপনা, পরিবেশ ব্যবস্থাপনাÑ সব মনে রেখে মহাপরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। কিন্তু এটার জন্য পূর্বশর্ত হচ্ছে দুই দেশের মধ্যে যথোপযুক্ত বিশ্বাসের সৃষ্টি করা।
এ বিষয়টির একটু বিশ্লেষণ প্রয়োজন। ৫৪ নদীর মধ্যে আমাদের একটি নদীতে চুক্তি হয়েছে। অর্থাৎ গঙ্গা নদী। এ গঙ্গাতে ফারাক্কায় যে পরিমাণ পানি উজানে তুলে নেয়ার পর তলানি হিসেবে পাওয়া যায় সেটুকুই দুই দেশের মধ্যে ভাগ হয়। যদি অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনাতে আমরা যেতে পারি তাহলে এ তলানি পানিটুকুর পরিমাণ অনেক বেড়ে যাবে। পশ্চিমবঙ্গের চাহিদা এবং বাংলাদেশের চাহিদা দুটোই তখন মিটবে; বিহারেরও অনুযোগ করার কিছু থাকবে না।
এখন দেখা যাক বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৯৯৬-তে যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল সেটির বর্তমান অবস্থা কী। আমি এখানে চুক্তির পরিবর্তে ইংরেজি শব্দ ট্রিটি ব্যবহার করব। কারণ, দুই দেশের মধ্যে ট্রিটি, এগ্রিমেন্ট, মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং বা সমঝোতা স্মারক ইত্যাদি সই হতে পারে। প্রতিটির আইনগত অবস্থান পৃথক এবং প্রতিটিতে স্বাক্ষরদানকারীদের দায়বদ্ধতাও পৃথক। চুক্তি শব্দটি ব্যবহার করলে অনাবশ্যক সীমাবদ্ধতা চলে আসে। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত দলিলটি ছিল একটি ট্রিটি। অর্থাৎ ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সমর্থন রয়েছে এটার পেছনে। এটা ভারতের পার্লামেন্ট কর্তৃক অনুমোদিত। এ চুক্তিটির তিনটি অংশ। প্রথম অংশ ফারাক্কাতে যে পরিমাণ পানি আসছে সেটার ব্যবস্থাপনা, বণ্টন এবং সেটার দুই নম্বর ধারায় ভারত অঙ্গীকার করেছে পানিকে তারা একটা মাত্রাতে রক্ষা করবে। আমার ধারণা মোটামুটি এই ব্যবস্থাপনা কাজ করছে। যেহেতু উজানে ব্যবহারের পরের তলানিটুকু ফারাক্কাতে আসছে সেহেতু ভাগের পরে আমরা যেটুকু পাই সেটুকুকে অপর্যাপ্ত মনে হতে পারে। এখন আমাদের প্রথম কাজ হবে ওইটুকু পানির সঠিক ব্যবহার করা। তার জন্য গঙ্গার ওপর একটি অবকাঠামো প্রয়োজন। গঙ্গার ওপর ব্যারাজের কথাটা আমরা বারবার বলছি এবং ব্যারাজের মাধ্যমে আমরা সর্বনিু প্রতি সেকেন্ডে যে ৩৫ হাজার ঘনফুট পানি পাই তার মধ্যে ১০ থেকে ১৫ হাজার ঘনফুট/সেকেন্ড গড়াই নদীর ভেতর দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলে পাঠানোর ব্যবস্থা করা। এতে কুষ্টিয়া, গোপালগঞ্জ, বরগুনা, বাগেরহাট, খুলনা এবং যশোর অঞ্চলের জেলাগুলো উপকৃত হবে। ১৯৯৭ সালে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়Ñ গঙ্গাচুক্তির পরে বাংলাদেশ যেটুকু পানি পাবে তা সদ্ব্যবহারের বিষয়ে। সেখানে ভারতীয় প্রতিনিধিরা বাংলাদেশকে এ ব্যাপারে সহযোগিতা দেয়ার সর্বাÍক প্রতিশ্র“তি দেন। বরং আমি লক্ষ্য করছি আমরাই এ সহযোগিতা নেয়ার জন্য প্রস্তুত নই।
১৯৯৬ সালের চুক্তির দ্বিতীয় অংশ হচ্ছে সব অভিন্ন নদীর মধ্যে পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা এবং যেহেতু এটি ট্রিটির অংশÑ আমি মনে করি ওই ট্রিটির ওই ধারার আওতায় সব নদীকে ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসা উচিত। তিস্তা হতে পারে তার প্রথম উদাহরণ। আর তৃতীয় অংশে আছেÑ যেহেতু ফারাক্কাতে যে পরিমাণ পানি আসে সেটা দুই দেশের জন্য পর্যাপ্ত নয়, সেহেতু এ পানির প্রবাহ প্রবৃদ্ধির ব্যবস্থা করা। এ লক্ষ্যেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। অর্থাৎ গঙ্গাচুক্তিতে দুই দেশ যেসব বিষয়ে অঙ্গীকার করেছে, সেগুলো বাস্তবায়নে তৎপর হওয়া।
বাকি নদীগুলোর ক্ষেত্রে কী করতে হবে। একটা কথা বলা বাহুল্যÑ প্রতিটি নদীকে আলাদা আলাদাভাবে বিবেচনা করতে হবে। এগুলোকে কয়েকটি ব্লকে ভাগ করে তার জন্য হয়তো কমন ফর্মুলা দাঁড় করানো যেতে পারে। তবে তিস্তা নদীর সঙ্গে গঙ্গাকে তুলনা করাটা ঠিক নয়। গঙ্গার ক্ষেত্রে পানি বণ্টন হচ্ছে একেবারে বর্ডারের কাছে ফারাক্কাতে। অথচ তিস্তাতে টেকনিক্যাল কারণে পানি ভাগ হতে হবে গজলডোবাতে যেটা সীমান্ত থেকে অনেক উজানে অবস্থিত। এ ক্ষেত্রে জটিলতাটা অনেক বেশি।
তিস্তার যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হতে হতেও হল না, কিংবা যেটি অল্প কিছুদিনের মধ্যে স্বাক্ষর হবে বলে আশা করা হচ্ছে সেখানে বলা হয়েছে চুক্তিটি হবে অন্তর্বর্তীকালীন। তাহলে এই অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তিতে ১৫ বছর ধরে অবশ্যই বহু সমীক্ষা চালানো হবে যাতে এই চুক্তিটি চূড়ান্ত চুক্তি হিসেবে রূপ দেয়া যেতে পারে। তিস্তা নদীটি কোনভাবেই যাতে পরিবেশ ও প্রতিবেশগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তার ব্যবস্থা রাখতে হবে। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে যে নদীটির ২০% প্রবাহ প্রতিবেশের ও প্রকৃতির জন্য ছেড়ে দেয়া হোক। আমরা লক্ষ্য করে দেখেছি তিস্তায় ভারত উজানে দু-তিনটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সেগুলোতেও বাংলাদেশের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করা উচিত।
নদীর পানির প্রাপ্যতার তুলনায় চাহিদা বেশি হলেই তো সমস্যা। চাহিদা যদি বেশি থাকে, প্রাপ্যতা যদি কম হয় তখনই তো বণ্টনের প্রশ্ন আসে। সেই ক্ষেত্রে গঙ্গা অববাহিকাতে যে সময়ে পানি বণ্টন করা হচ্ছে সেটি হচ্ছে ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে; আর তিস্তার ক্ষেত্রে এটি করতে হবে ১ সেপ্টেম্বর থেকে। কারণ সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে ভারত-বাংলাদেশের পানির চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। কারণ আমন ধানের মৌসুমের এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প এলাকাতে আমনের চাষ যাতে কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে ভারতের ব্যারাজটির ক্ষেত্রেও কিন্তু এটি বর্ষাকালের শেষের দিকে অর্থাৎ মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের প্রভাব যখন কমে যায় সেই সময়ে পানির প্রবাহ কমে গেলে আমন ধানকে সেচের পানি দেয়ার প্রকল্প। অর্থাৎ দুই দেশের প্রকল্পের ধরন একই রকম। এরপরে জানুয়ারি-ফেব্র“য়ারিতে প্রাকৃতিকভাবে পানির প্রাপ্যতা কমে যায়। ভারতের ক্যানেলের ধারণক্ষমতা হচ্ছে ১৬ হাজার কিউসেক, বাংলাদেশের ক্যানেলের ধারণক্ষমতা ৮ হাজার কিউসেক। অর্থাৎ দুই দেশের চাহিদা ২৪ হাজার কিউসেক। অথচ পানি আছে মাত্র ৫ থেকে ৬ হাজার কিউসেক। অর্থাৎ বণ্টনের পর সেখানে দুই দেশ যেটুকু পানি পাবে সেটুকুর যথাযথ ব্যবহার করাটাই হচ্ছে পরিকল্পনাবিদদের কাজ। তবে অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় এনে এ প্রবাহকে বাড়ানোর চেষ্টা অবশ্যই অব্যাহত রাখতে হবে। চাহিদার বিবেচনা করতে গেলে আমরা একটা নতুন ধারণা দেখছিÑ খোদ নদীর জন্য একটি চাহিদা রাখছি যেটি হচ্ছে প্রতিবেশের জন্য পানির চাহিদা। এর সঙ্গে যদি আমরা নৌ চলাচলের জন্য পানির চাহিদা যোগ করতে পারি এবং নদীতে নৌ চলাচলের জন্য পানির ব্যবস্থা করতে পারি তাহলে দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হবে। সীমান্ত অঞ্চলে ভারত ও বাংলাদেশের মালামাল পরিবহন সম্ভব হবে এবং নদীগুলোর স্বাস্থ্য অনেক ভালো থাকবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর ভেতর দিয়ে যেসব নদী প্রবাহিত হয়েছেÑ রাইন কিংবা দানিয়ুব কিংবা অন্য যে কোন নদী, সেগুলোর ব্যবস্থাপনায় বহু রাজনৈতিক জটিলতার অবসান সম্ভব হয়েছে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক সুসম্পর্ক থাকার কারণে। একটি ফেডারেল টাইপ অব গভর্নমেন্টের দুই স্টেটের ভেতর দিয়ে যখন পানি প্রবাহিত হয়, তখন ওই দুই স্টেটের মধ্যে পানি ব্যবস্থাপনার যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে ওইগুলোই হচ্ছে আন্তর্জাতিক মহলে পানি ব্যবস্থাপনার আইনগত নিয়মগুলোর নজির। এসব নজির বাস্তবায়নে অস্ট্রেলিয়া কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ভারত অভ্যন্তরীণভাবে কোনমতেই পিছিয়ে নেই। কাবেরি, কৃষ্ণা, গোদাগরি কিংবা নর্মদা নদীর ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ভারত অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করছে। আমি মনে করি, বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞদের অন্যতম কাজ হবে, ভারত তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা কিভাবে সমাধান করেছে সেখান থেকে নজির নিয়ে পরে বাংলাদেশ এবং ভারতের সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সেই পদ্ধতিগুলোকে কাজে লাগানো। আমি মনে করি, পানিসম্পদের বর্তমান যে চিত্রটি আছে এটা ভবিষ্যতে আরও জটিল হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার কারণে সমগ্র পৃথিবীতে বৃষ্টিপাতের বর্তমান যে হাইড্রোলজিক সাইকেল আছে সেটা মারাÍকভাবে পরিবর্তিত হবে। মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণও বাড়তে পারে। কিন্তু আগে যেখানে বৃষ্টিপাত বেশি হতো সেখানে কম হতে পারে আবার যেখানে বৃষ্টিপাত কম হতো সেখানে বেশি হতে পারে। অর্থাৎ নদীগুলোর হাইড্রোলজিক চরিত্র বদলে যাবে এবং সেই ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে পানিবণ্টন ব্যবস্থাটি আরও জটিল হবে। কাজেই আমরা দু’দেশের মধ্যে সহযোগিতার ভিত্তিতে বাংলাদেশ এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রীরা যে নির্দেশ দিয়েছেন সেটাকে ধরে নিয়ে সেটার মাধ্যমে যদি এগিয়ে যেতে পারি এবং এ অগ্রযাত্রা যত দ্রুত হবে ততই দু’দেশের জন্য মঙ্গল। এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব হচ্ছে দু’দেশের টেকনোক্রেট ও আমলাদের হাতে। আমি আশা করব, বাংলাদেশ ও ভারতের দুই প্রধানমন্ত্রীর পরবর্তী বৈঠক যখন হবে, তখন তাদের নির্দেশ অনুযায়ী আমলারা অনেক দূর এগিয়ে যাবেন।
ড. আইনুন নিশাত
প্রফেসর ড. আইনুন নিশাত : ভাইস চ্যান্সেলর, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন