বুধবার, ৫ অক্টোবর, ২০১১

দাঁড়াবার জায়গা


সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

বাঙালির জন্য আত্মপরিচয়ের একটা সঙ্কট আছে, শুনেছি আমরা। ব্যাপারটা মিথ্যা নয়, আত্মপরিচয় নিয়ে সমস্যা ছিল, এখনও আছে। ব্যাপারটাকে দাঁড়াবার জায়গাও বলা যায়। তার স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বাঙালি কোথায় দাঁড়াবে, কোন অবস্থান থেকে মুখোমুখি হবে পৃথিবীর এই জিজ্ঞাসাটা তার জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাঙালির একটা পরিচয় ধর্মীয়, যেখানে সে হিন্দু কিংবা মুসলমান, আরেকটা পরিচয় ভাষাভিত্তিক, যেখানে সে কেবলই বাঙালি।

ধর্মীয় পরিচয়টা তাকে আবার উত্তর ভারতের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছে, সে হয়েছে ভারতীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্য, কিংবা সদস্য ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের। এই সমস্যাটা আবুল হাশিমের জন্যও ছিল, যেমন ছিল আত্মসচেতন অন্য বাঙালির জন্যও। তিনি মনে করতেন, তিনি দুটোই, যেমন বাঙালি তেমনি মুসলমান, দুয়ের মধ্যে কোনো বিরোধ আছে বলে মানতেন না।

কিন্তু বিরোধ তো অবশ্যই ছিল। নইলে সাতচল্লিশের ওই ভয়ঙ্কর বিভাজনটা ঘটল কেন। অনেকেই মনে করেন যে, বাঙালির রাজনৈতিক জীবনে এত বড় দুর্যোগ আর ঘটেনি। সে নিয়ে অবশ্য তর্ক চলে। সাতচল্লিশের বিপর্যয় অত্যন্ত গভীর ও মর্মান্তিক অবশ্যই; কিন্তু ইতিহাসের দৃষ্টিতে ইংরেজের বঙ্গবিজয়ও কম ক্ষতি করেনি, বিশেষত এ দিক থেকে যে সাতচল্লিশের দুর্ঘটনার বীজ ইংরেজের আগমনের মধ্যেই নিহিত ছিল। সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও শোষণের প্রয়োজনে বিভেদ সৃৃষ্টিতে উত্সাহদানের ফলেই বাংলা ভাগ হয়েছে। তর্ক থাকুক, কিন্তু সাতচল্লিশের বিভাজন যে ভীষণ ঘটনা তাতে কোনো সন্দেহ নেই।


আবুল হাশিমের জন্ম ১৯০৫ সালে। অর্থাত্ সেই বছর, যে বছর বৃটিশ শাসকেরা তাদের নিজেদের স্বার্থে বাংলাকে ভাগ করার ব্যবস্থা করেছিল। বঙ্গভঙ্গ-প্রতিরোধ আন্দোলনের মধ্যে একটা গতি ছিল, প্রগতিশীলতাও ছিল, বিশেষ করে এই জন্য যে, ওই আন্দোলন ছিল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। কিন্তু আলোর নিচে অন্ধকারও থাকে, ছিল এই ক্ষেত্রেও। বঙ্গভঙ্গ ঠেকাতে গিয়ে অগ্রসর হিন্দু মধ্যবিত্ত চেষ্টা করল সে বাঙালি হবে, কিন্তু বাঙালি হতে গিয়ে সে হিন্দু হয়ে গেল এবং তার বিপরীতে উঠতি মুসলমান মধ্যবিত্তও তার মুসলমানত্বকে উচ্চমূল্য দিতে তত্পর হয়ে উঠল। এর ফলে জাতীয়তাবাদ রূপ নিল সাম্প্রদায়িকতার এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে আমরা পেলাম পারস্পরিক শত্রুতার দ্বারা চিহ্নিত হিন্দু জাতীয়তাবাদ ও মুসলিম জাতীয়তাবাদ। দাঁড়াবার জায়গাটা যে কেবল ছোট হয়ে গেল তা নয়, অনিরাপদও হয়ে পড়ল। ১৯০৫-এর সেই সূত্রপাতই তো পরিণত রূপ নিয়েছে ১৯৪৭-এ। যেন একটা যৌক্তিক পরিণতি।

আবুল হাশিমের রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত সময় হচ্ছে সাতচল্লিশের পূর্বেকার দশ বছর। ব্যক্তিগতভাবে তিনি মনে করতেন বাঙালির দুই পরিচয়ই সমান জরুরি। তিনি যেমন মুসলমান তেমনি বাঙালি। এই বিশ্বাস তাঁর সর্বদাই ছিল। যৌবনে তিনি বাঙালি মুসলমান, পরিণত বয়সেও তা-ই, এমনকি তখনও যখন তিনি কাজ করছেন তাঁর স্বপ্নের ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র গড়বার জন্য। কিন্তু বিশ্ব সংসারের কোথাও সাম্য নেই, সাম্য থাকে না, সব শক্তিই আধিপত্যবাদী; ওই যে দুটি সত্তা, একটি বাঙালি অপরটি মুসলমান, তাদের মধ্যেও দ্বন্দ্ব ছিল আধিপত্যের, যে জন্য দেখা গেছে তিনি মুসলিম লীগের রাজনীতিই করেছেন এবং আরও পরে রব্বানিয়াতের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। কিন্তু তাই বলে তাঁর বাঙালি সত্তাটি আত্মসমর্পণ করেননি। যে জন্য সাতচল্লিশে তাঁকে দেখি বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর যখন তিনি দৃষ্টিশক্তিহীন, বাড়িঘর ছেড়ে শরণার্থী হিসেবে চলে এসেছেন ঢাকায়, তাঁর কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নেই, থাকবার মতো বাসগৃহ পর্যন্ত নেই, তখন আবার তিনি সক্রিয় হয়ে উঠছেন, বাংলা ভাষাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন। আগেরবার তাঁকে কারাভোগ করতে হয়নি, এবার স্বাধীন পাকিস্তানে, যে পাকিস্তানের জন্য একদা তিনি মনে-প্রাণে কাজ করেছিলেন সেই রাষ্ট্রে তাঁকে কারাবন্দি হতে হলো। একটানা ১৬ মাস ছিলেন তিনি জেলে। কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে না, একান্তই ব্যক্তিগত পরিচয়ে। অবিশ্বাস্য, কিন্তু সত্য। আরও পরে পাকিস্তানি শাসন কর্তৃপক্ষ যখন সংস্কৃতি থেকে রবীন্দ্রনাথকে বাদ দেয়ার চেষ্টা করছিল, তখনও তিনি রুখে দাঁড়িয়েছেন। সেই আগের মতোই। দুই ব্যাপারেই ছিলেন আপসহীন, যেমন ইসলামের ব্যাপারে তেমনি বাঙালিত্বের।

সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিকাশের যুগে তিনি রাজনীতি করেছেন। তাঁর মেধা, সাংগঠনিক দক্ষতা, দার্শনিকতা সবকিছুরই সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটেছে ওই টালমাটাল সময়ে। অতিদ্রুত এগিয়ে গেছেন, প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন, কোনো মহল বিশেষের পক্ষপাতে নয়, একেবারেই নিজের যোগ্যতায়। হওয়ার পর সেই সংগঠনকে নবাব-নাইট ও ব্যবসায়ীদের হাত থেকে উদ্ধার করে নিয়ে গেলেন সাধারণ মানুষের কাছে। যেমনটি কখনও ঘটেনি, ওই প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসে যা ছিল না তাই করলেন, সারা দেশময় তাকে সাংগঠনিকভাবে ছড়িয়ে দিলেন, হাজার হাজার সদস্য সংগ্রহ করলেন, জেলায় জেলায় অফিস বসল, কেন্দ্রীয় কার্যালয় সুসংহত হলো, সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হলো। সেকালের বাংলাদেশে এমন কাজ অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে হয়নি, কংগ্রেসেও নয়, কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষেও করা সম্ভব ছিল না, কেননা পার্টিকে অনেক সময়ই কাজ করতে হতো গোপনে। বাংলার মুসলিম লীগকে তিনি সামন্তবাদের যুগ থেকে বুর্জোয়া বিকাশের যুগে নিয়ে এলেন। সব উদ্যোগ আয়োজনের লক্ষ্য দাঁড়াল একটিই, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা। সে পাকিস্তান হবে স্বপ্নের ভূমি। বাঙালি মুসলমান সেখানে জায়গা পাবে দাঁড়াবার। কিন্তু সাতচল্লিশে এসে যখন দেখলেন স্বপ্নের ভূমি পাওয়া যাচ্ছে না, বরঞ্চ ভৌগোলিক ভূমিকে কেটে দু’টুকরা করার আয়োজন চলছে তখন তিনি প্রতিবাদ করলেন। কেবল প্রতিবাদ নয়, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলেন শরত্ বসু-কিরণশঙ্কর রায়দের সঙ্গে মিলে। সে চেষ্টা সফল হয়নি। সফল না হওয়াই ছিল স্বাভাবিক। কেননা, তখন জোয়ার হচ্ছে হিন্দুস্থান-পাকিস্তানের, সেখানে বাঙালির জন্য স্বতন্ত্র ব্যবস্থার কথা শুনতে কংগ্রেস ও লীগের নেতৃত্ব প্রস্তুত ছিল না। তদুপরি শরত্ বসুর দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আবুল হাশিমের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যও ছিল। শরত্ বসু সমাজতন্ত্রের কথা বলতেন। সমাজতন্ত্র ইহজাগতিক। আবুল হাশিমের রাজনীতিতে পাকিস্তানের দাবি ছিল এবং সে রাজনীতি ধর্মনিরপেক্ষ ছিল না। দুই পক্ষ যে কিছুটা হলেও এগিয়ে ছিলেন সেটা স্মরণীয়। কিন্তু ওই টুকুই। ওর বেশি এগুনো একেবারেই অসম্ভব ছিল।

এমনকি তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠানের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গেও যে আবুল হাশিমের পুরোপুরি মিল ছিল তা নয়। সোহরাওয়ার্দী যুক্তবঙ্গের প্রবক্তা হয়েছেন তিনি বাঙালি ছিলেন বলে নয়, তিনি কলকাতার লোক ছিলেন বলে। বাংলা ভাগ হলে কলকাতা চলে যাবে, কলকাতা চলে গেলে তিনি নিজেও গুরুত্ব হারাবেন, ঢাকা হবে রাজধানী, ঢাকা তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী খাজা নাজিমুদ্দিনদের কর্মক্ষেত্র, সেখানে তাঁর স্থান হবে না, ভয় ছিল এটাই। তার সে ভয় যে অযৌক্তিক ছিল তা নয়। বাংলাকে বিভক্ত করে যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলো তাতে সোহরাওয়ার্দীর স্থান হয়নি। স্থান আবুল হাশিমেরও হয়নি। কিন্তু তিনি পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে লাহোর চলে যাননি, সোহরাওয়ার্দী যেমন গেছেন। এমনকি ঢাকাতেও আসতেন না যদি না দাঙ্গাবাজরা পঞ্চাশ সালে বর্ধমানে তাঁর ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিত। বঙ্গভঙ্গের পরও তিনি পশ্চিমবঙ্গ আইন পরিষদে বিরোধী দলের নেতা ছিলেন। কর্তব্যচ্যুত হননি।
সোহরাওয়ার্দীর রাজনীতির সঙ্গে তুলনা করলে আবুল হাশিমের স্বাতন্ত্র্যটা বড় সহজে চোখে পড়ে। সোহরাওয়ার্দীর নামডাক, প্রভাব-প্রতিপত্তি সবই বেশি ছিল আবুল হাশিমের তুলনায়। কিন্তু রাজনীতির মধ্য দিয়ে আবুল হাশিম যা অর্জন করতে চেয়েছিলেন সোহরাওয়ার্দী লক্ষ্য থেকে তা স্বতন্ত্র। হাশিম চেয়েছিলেন সমগ্র জনগোষ্ঠীর জন্য দাঁড়াবার জায়গা, সোহরাওয়ার্দী চেয়েছিলেন নিজের জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতা। প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে হাশিম দলের ঘোষণাপত্র, কর্মসূচি, লক্ষ্য, আদর্শ, উদ্দেশ্য ইত্যাদি নিয়ে চিন্তা করেছেন, যেসব প্রশ্ন নিয়ে ভাববার সময় সোহরাওয়ার্দীর ছিল না। আর ওই যে মুসলমানত্ব ও বাঙালিত্ব নিয়ে চিন্তা সে সম্পর্কেও সোহরাওয়ার্দী মোটামুটি উদাসীন ছিলেন। সোহরাওয়ার্দী বাংলাদেশে রাজনীতি করতেন, কিন্তু হাশিমের মতো বাঙালি ছিলেন না; তিনি মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে রাজনীতি করতেন কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে যে ভাবতেন তেমন প্রমাণ নেই। সে জন্য দেখা যায়, রাষ্ট্রভাষা বাংলার যে দাবি সোহরাওয়ার্দী তার সমর্থক ছিলেন না, যদিও ওই আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে যুক্তফ্রন্টের যে বিজয় তার ফললাভ করে তিনি পাকিস্তানের প্রথমে আইনমন্ত্রী ও পরে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। সবচেয়ে তাত্পর্যপূর্ণ ঘটনা এই যে, প্রধানমন্ত্রী হয়েই তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের আর দুশ্চিন্তার কারণ নেই, সে শতকরা ৯৮ ভাগ স্বায়ত্তশাসন পেয়ে গেছে। আবুল হাশিম যেভাবে অখণ্ড বাংলার কথা ভেবেছেন, সোহরাওয়ার্দী সেভাবে ভাবেননি। আবুল হাশিম একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান চেয়েছিলেন, সোহরাওয়ার্দী কী চেয়েছিলেন তা মোটেই স্পষ্ট নয়। কেননা সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তান যে দুটি হবে না একটিই হবে, অর্থাত্ অখণ্ড হবে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর এই ধারণার যে কেবল সমর্থক ছিলেন তা নয়, ১৯৪৬ সালে দিল্লিতে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মুসলিম ব্যবস্থাপকদের সম্মেলনে লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তান একাধিক রাষ্ট্রের সমন্বয়ে গঠিত হবে বলে যে বক্তব্য ছিল তা সংশোধন করে জিন্নাহর ইচ্ছামত অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে তিনি এক সংশোধনী উত্থাপন করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই সেটি গৃহীত হয়েছিল। জিন্নাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়ার ক্ষমতা মুসলিম লীগে কারও ছিল না। একে ফজলুল হকের বিতাড়িত হওয়ার দৃষ্টান্ত তো সামনেই ছিল খোলা।

এরপরও ঘটনা ঘটেছে, ১৯৪৭-এর জুন মাসে বাংলা ও পাঞ্জাব বিভক্তির ঘোষণা জারি হওয়ার পরে। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, বিভাজন প্রচেষ্টার তারা বিরোধিতা করবে। এর আগে এপ্রিল মাসের ৮ তারিখে মুখ্যমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী এক সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, তিনি সব সময়েই বিশ্বাস করে এসেছেন, বাংলাকে বিভক্ত করা অসম্ভব। বলেছেন, তিনি অখণ্ড ও বৃহত্তর বঙ্গের পক্ষে। বাংলা ও পাঞ্জাবকে বিভক্ত করার সম্পর্কে মাউন্টব্যাটনের প্রস্তাব গ্রহণ-বর্জনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য দিল্লিতে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশন ডাকা হয়। স্বাভাবিকভাবেই এটা প্রত্যাশিত ছিল যে, বাংলার কাউন্সিলররা বর্জনের পক্ষে রায় দেবেন এবং তাতে নেতৃত্ব দেবেন তাঁদের নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। কিন্তু ঘটনা ঘটল উল্টো রকমের। সোহরাওয়ার্দী দিল্লি পৌঁছেছিলেন অন্যদের আগে। সভার দিন সভাস্থলে প্রবেশের মুহূর্তেই আবুল হাশিম বুঝলেন যে, জিন্নাহর সঙ্গে আলাপের ফলে সোহরাওয়ার্দী তাঁর অবস্থান পাল্টে ফেলেছেন।

সভায় জিন্নাহ মাউন্টব্যাটনের প্রস্তাব গ্রহণের পক্ষে প্রস্তাব উত্থাপন করলেন। মওলানা হসরত মোহানী এবং আবুল হাশিম তাদের বক্তব্য রাখার চেষ্টা করেন, কিন্তু জিন্নাহ তাঁদের বিরত রেখেছেন। জিন্নাহ জানতেন এই দু’জনের বক্তব্য বিপজ্জনক হবে। তিনি বলেছেন, আলোচনার কিছু নেই, হ্যাঁ বা না মত জানাতে হবে হাত উঠিয়ে। সেভাবেই ভোট নেয়া হলো। সোহরাওয়ার্দী ভোট গণনা করলেন এবং বিজয়ীর সুরে ঘোষণা করলেন, ‘কায়দে আজম, মাত্র এগারজন আমাদের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন।’ এভাবে বঙ্গ বিভাজনের প্রস্তাব পাস হয়ে গেল এবং ৭ জুন এক প্রেস বিবৃতির মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী বললেন, ‘ঢাকা এখন পাকিস্তানে।’


সোহরাওয়ার্দীকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা পছন্দ করতেন না। ছেচল্লিশের দাঙ্গায় সোহরাওয়ার্দীর ভূমিকা সম্পর্কে তাদের অভিযোগ ছিল। ১৯৪৭-এর ১১ মে বঙ্গভঙ্গ রদের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার জন্য আবুল হাশিমকে নিয়ে সোহরাওয়ার্দী গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন। একপর্যায়ে সোহরাওয়ার্দী কিছুটা রাগ করেই কামরা থেকে বেরিয়ে যান। সোহরাওয়ার্দী চলে যাওয়ার পর গান্ধী মন্তব্য করেছিলেন, ‘হাশিম, সোহরাওয়ার্দীকে নিয়ে অসুবিধা হচ্ছে এই যে, কেউই তাঁকে বিশ্বাস করতে চায় না।’

আবুল হাশিম সম্পর্কে এরকম অনাস্থা প্রকাশের কোনো সুযোগ ছিল না। তার অবস্থান সব সময়ই অত্যন্ত দৃঢ় ছিল। সুবিধাবাদিতাকে প্রশ্রয় দিতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। ফজলুল হকও বড় মাপের নেতা। তার জন্যও মুসলমান না বাঙালি, কোনটি আগে কোনটি পরে এই জিজ্ঞাসা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বাঙালি মুসলমানের তিনি কম উপকার করেননি। কিন্তু তিনি আপস করে ফেলতেন। আবুল হাশিম করতেন না। রাজনীতিতে আপসহীনতার তিনি এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

জিন্নাহ আবুল হাশিমকে বলতেন ‘মওলানা সাহেব’। বিদ্রূপ নয় তবে পিঠচাপড়ানো নিশ্চয়ই। বলবার কারণ সম্ভবত এই যে, হাশিম ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে ভাবতেন। নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত অন্য কেউ অমনভাবে ভাবতেন না। তাঁর একটা স্বপ্ন ছিল। একটা দার্শনিকতা। যার জন্য তিনি অধ্যয়ন করেছেন, চিন্তা করেছেন এবং লিখেছেন। চিন্তায় অবাস্তবতা ছিল অবশ্যই, কিন্তু রাজনীতিকে তিনি দরকষাকষি কিংবা ভোট গোনাগুনিতে সীমাবদ্ধ রাখতে চাননি। তিনি কমিউনিজম-বিরোধী ছিলেন, কিন্তু কমিউনিস্টদের সঙ্গে তাঁর মিল ছিল, কেবল কর্মপন্থায় নয়, রাজনীতির সঙ্গে দর্শনকে সম্পৃক্ত করার অভিপ্রায়েও। যে কারণে রক্ষণশীলরা তাঁকে ছদ্মবেশী কমিউনিস্ট বলত।

মাওলানা আকরম খাঁও লিখতেন এবং ভাবতেন। কিন্তু তিনি রাজনীতির জন্য আদর্শবাদিতাকে অপরিহার্য জ্ঞান করতেন না। মোটেই না। মাওলানার সুবিধাবাদ বিখ্যাত ছিল। রাজনীতিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন দুই কারণে, এক. তাঁর হাতে আজাদ পত্রিকা ছিল। দুই. এবং যেটা আরও বড়, তিনি লীগের অভ্যন্তরে কায়েমি স্বার্থবাদীদের পক্ষ নিতেন। তাদের জন্য কাজ করতেন। আবুল হাশিম ছিলেন তরুণ ও প্রগতিশীলদের নেতা। তরুণদের চুম্বকের মতো তিনি নিজের কাছে টেনে নিতেন। কিন্তু সীমাবদ্ধতা ছিল দুটি, একটি দার্শনিক, অপরটি শারীরিক। আবুল হাশিম তাঁর ইসলামকে বিপ্লবী বলতেন। রক্ষণশীলদের মতবাদের তুলনায় তা বৈপ্লবিক ছিল বৈকি; কিন্তু প্রকৃত সমাজ বিপ্লবের জন্য তার ওই দর্শন মোটেই উপযোগী ছিল না।

মাওলানা আকরম খাঁর কথা উল্লেখ করলাম। আবুল হাশিম যখন প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আকরম খাঁ তখন তার সভাপতি। দু’জনের দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনীতিতে পার্থক্যটা যে কেমন মৌলিক ছিল তা নানাভাবে প্রকাশ পেয়েছে। আবুল হাশিম তাঁর রাজনৈতিক আত্মজীবনী ‘ইন রিট্রোসপেকশনে’ ওরকম একটি ঘটনা স্মরণ করেছেন। ব্যাপক হারে লীগের সদস্য সংগ্রহের লক্ষ্যে আবুল হাশিম ঠিক করেছিলেন পাঁচ লাখ রসিদ ছাপাবেন এবং সব বাংলাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে দেবেন। তখন যুদ্ধের সময়। কাগজ পাওয়া যায় না। কি করবেন? শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল। কালোবাজারি দামে লীগের জন্য রসিদ বই ছাপতে অন্য কোথাও নয়, আজাদ অফিসেই। লীগ সম্পাদককে কাগজ কিনতে হলো লীগ সভাপতি আকরম খাঁর পত্রিকা অফিস থেকে। ‘আজাদ’ তখন ছাপা হতো পাঁচ হাজারের মতো, ক্ষমতায় যেহেতু লীগ সরকার তাই ‘আজাদের’ পারমিট ছিল বিশ হাজারের। না-ছাপানো পনের হাজার কপির কাগজ কালোবাজারে চলে যেত। সেখান থেকেই রসিদ বই ছাপার কাগজ সংগ্রহ করতে হয়েছিল। আমরা জানি যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের একটি বড় অভিযোগ ছিল এই যে, আকরম খাঁ সদস্য সংগ্রহের রসিদ বই কুক্ষিগত করে ফেলেছিলেন, অন্যদের দিতেন না। আবুল হাশিম একটি গণতান্ত্রিক মুসলিম লীগ ও গণতান্ত্রিক পাকিস্তান চেয়েছিলেন; অন্যপক্ষ দুটির কোনোটিই চায়নি। তারা দেখেছে নিজেদের স্বার্থ।

২.
তাঁর রাজনৈতিক জীবনে আবুল হাশিম নানা বিষয়ে বিবৃতি দিয়েছেন; এদের মধ্যে সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তার একটি দীর্ঘ বিবৃতি। সাতচল্লিশের ২৯ এপ্রিল এটি কলকাতার দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত হয়েছিল। বঙ্গভঙ্গের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা তখনও প্রকাশ পায়নি। কিন্তু পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, ঘটনা সেদিকেই এগুচ্ছে। আবুল হাশিম বর্ধমানে ছিলেন, সেখান থেকে কলকাতায় এসে তিনি বিবৃতিটি দেন। এই বিবৃতিতে অনেকগুলো উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল।

প্রথমত তিনি বলছেন, বাংলা চলে গেছে ‘বিদেশি’ নেতৃত্বের অধীনে। বিদেশি নামকরণটি তাত্পর্যপূর্ণ। উত্তরভারতীয় নেতৃত্বকে তিনি বঙ্গভঙ্গের জন্য দায়ী করছেন। হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেসের বল্লভ ভাই প্যাটেলপন্থীরা বঙ্গভঙ্গ চেয়েছিল। তিনি বললেন, তাই বাংলার এই করুণ দশা। বাঙালি হিন্দুর হলো কী?

এর চেয়েও উল্লেখযোগ্য বক্তব্য ছিল পুঁজির দৌরাত্ম্য সম্পর্কে। তার মতে, ‘যেসব বহির্ভারতীয় ও ইঙ্গ-মার্কিন পুঁজিপতি বাংলা শোষণ করিতেছে তাহাদের সমস্ত মূলধন খাটিতেছে পশ্চিমবঙ্গে। আমাদের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিদেশী শোষকগণ তাহাদের সম্পত্তিচ্যুত হইবার ভয়ে ভীত হইয়া উঠিয়াছে। স্বাধীন ও ঐক্যবদ্ধ বাংলায় তাহাদের যে কি অসুবিধা হইবে সে কথা কল্পনা করার বুদ্ধি তাহাদের আছে। বিদেশী পুঁজিপতিরা তাহাদের নিজেদের স্বার্থের জন্যই চায় যে, বাংলা বিভক্ত, পঙ্গু ও শক্তিহীন হইয়া পড়ুক, কেননা তাহা হইলে বিদেশীদের প্রতিরোধ করার মতো শক্তি কাহারও থাকিবে না।’ এরকম বক্তব্য সেই সময়ে খুব একটা পাওয়া যায়নি। মুসলমান শিবিরে তো নয়ই।

ওই বিবৃতিতে আবুল হাশিম প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের ওপর ভরসা করেননি। সে নেতৃত্ব নিজেদের স্বার্থ দেখছে, দেশের স্বার্থ দেখা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাঁর ভরসা ছিল বাংলার হিন্দু ও মুসলমান যুবকদের ওপর। তাদের তিনি ডাক দিয়েছেন ঐক্যবদ্ধ হতে। তারা এবং কেবল তারাই পারবে, ‘মাতৃভূমিকে বহিঃপ্রভাবের শৃঙ্খল হইতে মুক্ত করিয়া বাংলার হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করিয়া ইহাকে ভারতের তথা বিশ্বের ভবিষ্যত্ জাতিসংঘে সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত করিতে।’

কেবল বক্তব্য নয়, ভাষাও লক্ষ্য করবার মতো। মূল বিবৃতিটি ইংরেজিতে লেখা। এর ভাষা পরিচ্ছন্ন ও দৃঢ়। যাঁরা তার বক্তৃতা শুনেছেন তাঁরা জানেন তাঁর শব্দচয়ন কেমন সুনির্বাচিত ও কার্যকর ছিল। মনে হতো প্রবন্ধ থেকে পড়ছেন। অথচ বক্তৃতাই করছেন, অধিকাংশ সময়েই তাত্ক্ষণিকভাবে। ভাষা বক্তব্যের স্বতঃস্ফূর্ততাকে ব্যাহত করেনি, বরঞ্চ দুয়ে মিলে চমত্কার প্রবাহ সৃষ্টি করেছে। ফজলুল হক এবং মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীও চমত্কার বক্তা ছিলেন। কিন্তুু আবুল হাশিমের বক্তৃতা ছিল আলাদা। ওপরে উদ্ধৃত বিবৃতির মতোই। ভাষাকে কখনও নিচে নামাতেন না, ফজলুল হক নামাতেন, জনসভায় বক্তৃতা করার সময় ফজলুল হক গল্প বলতেন, কার্যকর রসিকতা করতেন, গলার ওঠানামা চলত। আবুল হাশিম কথা বলতেন একই সুরে। শিক্ষিত, মার্জিত এবং উদ্দীপক। মওলানা ভাসানীও অত্যন্ত উদ্দীপক ছিলেন তার ভাষণে। তিনি ছিলেন ওজস্বী। আবুল হাশিমের স্বতঃস্ফূর্ততা ওজস্বী ছিল না। তিনি আবেদন করতেন প্রথমত যুক্তির কাছে : তারপর আবেগের কাছে।

সেই যে দাঁড়াবার প্রশ্ন সে বিষয়ে আবুল হাশিমের নিজস্ব সিদ্ধান্ত খুব স্পষ্ট ছিল। ১৯৬৯-এ ঢাকায় অনুষ্ঠিত একটি প্রতিবাদ সভায় তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা একই সঙ্গে বাঙালি, মুসলমান ও পাকিস্তানি এবং আমাদের বাঙালিত্ব স্থায়ী ও অপরিবর্তনীয়।’ বাঙালিত্বকে স্থায়ী ও অপরিবর্তনীয় মনে করেছেন তিনি। যে জন্য সাতচল্লিশে বঙ্গভঙ্গ প্রতিহত করতে চেয়েছিলেন, বায়ান্নতে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাবন্দি হয়েছেন।
এই বাঙালিত্ব নানাভাবে আক্রান্ত হয়েছে, এখনও হচ্ছে। শ্রেণী, সম্প্রদায়, সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, আদর্শগত আধিপত্য—এসব নানা বিপদ বাঙালিকে জব্দ করছে। আবুল হাশিম তাঁর কালে এসব শত্রুর সামনাসামনি হয়েছেন, তাঁর নিজের মতো করে। রাজনীতিকে তিনি অবসরভোগীদের বিলাস কিংবা সুবিধাবাদীদের মৃগয়া ক্ষেত্র হিসেবে দেখেননি, রাজনীতির সঙ্গে দার্শনিকতাকে যুক্ত করেছেন, গড়ে তুলতে চেয়েছেন নতুন সমাজ ও রাষ্ট্র, মানুষ যেখানে দাঁড়াবার জায়গা পাবে, তার আত্মপরিচয় নিয়ে এবং মুক্তিও পাবে পীড়ন থেকে। রাজনীতিতে তিনি ছিলেন সার্বক্ষণিক কর্মী। অসাধারণ ছিল তাঁর সাংগঠনিক শক্তি, অতুলনীয় বাগ্মিতা। কিন্তু যা তার করার ছিল তার সবটা করতে পারলেন না। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন সাতচল্লিশে, উদ্বাস্তু হলেন পঞ্চাশে এবং দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন যখন তার কাজ করবার শ্রেষ্ঠ সময় তখনই। অত্যন্ত বড় মাপের একটা অপচয় ঘটে গেছে। আমাদের দেশ তো অপচয়েরই দেশ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন