মঙ্গলবার, ১১ অক্টোবর, ২০১১

প্রধানমন্ত্রী হত্যার ষড়যন্ত্র-৪


তালিম হোসেনের কাছে যাওয়ার আগে আমারও তাদের ওপর ক্ষোভ ছিল। এত বিদ্বান, জ্ঞানী-গুণী মানুষ তারা, যুদ্ধের পুরো সময় পাকিস্তানের সেবাদাস হিসেবে কাজ করলেন কেন? কিন্তু কবি তালিম হোসেনের কথা শুনে ও অন্যদের সঙ্গে কথা বলে আমার বেশ খটকা লেগেছিল। তাইতো, বিষয়টা একটু তলিয়ে দেখা দরকার। ১৩ তারিখ পর্যন্ত যারা অবলীলায় ঢাকায় থেকে পাকিস্তানিদের সব হুকুম হাকাম পালন করেছে, ১৪ তারিখ সুবেহ সাদেকে সেই পাকিস্তানিদের হাতে নিহত হয়ে সবাই পূতঃপবিত্র হয়ে গেল? আর যারা বেঁচে ছিল তাদের কেউ কেউ দালাল হলো? এটা কেমন বিচার? তখন অতটা বুঝিনি। এখন কিছু কিছু বুঝি আমাদের গলদ কোথায়। যারা পূর্ব পাকিস্তান প্রশাসনকে চালু রেখেছিল শিক্ষা, দীক্ষা, সংস্কৃতি সব অঙ্গনকে যে কোনোভাবেই হোক জীবিত রেখেছিল, তারা আর সব কিছু বিসর্জন দিয়ে অনিশ্চয়তার পথে যারা পা বাড়িয়েছিল তাদের স্বাধীনতার পরপরই একাকার করে ফেলা হয়েছিল। কারও কোন ত্যাগ-তিতিক্ষা আর ব্যর্থতার পার্থক্য করা হয়নি। সারাদেশের ঘটনা বলতে বসিনি। ওটা গবেষকদের কাজ। তখন পূর্ব পাকিস্তানে যে ক’জন সেক্রেটারি ছিল তাদের মধ্যে পাকিস্তানের প্রতি খুবই কট্টর দু’একজন ছাড়া আর সবাই স্বপদে বহাল ছিল। সব এসপি ডিসি প্রশাসনে অভিজ্ঞ বলে তারা তাদের দায়িত্ব চালিয়ে যাচ্ছিল। এমনকি সব জেলের জেলার, সুপার, আইজি, ডিআইজি পূর্ব পাকিস্তান আমলে যারা ছিল, বাংলাদেশ আমলেও তারাই ছিল। পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধাদের জেলে রাখতো, বাংলাদেশ হলে রাজাকার আলবদর এবং কিছু পাকিস্তানি দালালের সেবাযত্ন করছিল। তাদের চাকরি আগেও যেমন পরেও তেমন ছিল। স্বাধীনতার পর অনেক নেতানেত্রী ঢাকা দেখার আগে আমি বঙ্গভবনে গেছি। সেখানে ফিরোজ সালাহউদ্দিন নামে এক মোছওয়ালা কর্নেল গভর্নর ডা. মালেকের শেষ দিন পর্যন্ত মিলিটারি সেক্রেটারি ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে আমার দাদু সৈয়দ নজরুল ইসলাম বঙ্গভবনে এলে তারও মিলিটারি সেক্রেটারি ছিল সেই কর্নেল ফিরোজ সালাহউদ্দিন। বর্তমান বিদ্যুত্ প্রতিমন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার এনাম তখন ক্যাপ্টেন হিসেবে প্রেসিডেন্টের এডিসি। মোশারফ নামে এয়ারফোর্সেরও এক এডিসি ছিল। এরা সবাই ফিরোজ সালাহউদ্দিনকে সটান স্যালুট করত। উপায় কি? সামরিক নিয়মে এমনই রীতি। ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত কর্নেল ফিরোজ সালাহউদ্দিন পাকিস্তানের আজ্ঞাবহ ছিল। ১৬ ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশের আজ্ঞাবহ হয়েছে। যন্ত্রের তো কোন কর্তৃত্ব নেই। যন্ত্রীর ইচ্ছায় যন্ত্র চলে। ২২ ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকার ঢাকা এলে যথারীতি বাংলাদেশ সরকারের সেবা শুরু করে। এতদিন পাকিস্তানের একটি প্রদেশের গভর্নরের সেবা করত, এখন একটা দেশের প্রেসিডেন্টের সেবা করছে। এতো আরও গর্বের কথা। যেখানে গুঁতানাতা খাওয়ার কথা, জেলের ঘানি টানার কথা, সেখানে তার হুকুমে আগেও যেমন অনেকে ঘানি টানত, তখনও ঘানি টানে। এখানে জনাব এনামদের কি করা? তারা নিয়মিত সৈনিক। ঠিকানাবিহীন মুজিব নগরে যাকে যা করতে বলা হয়েছে তাই করেছে। ঢাকায় এসে কর্নেল পদবির ফিরোজ সালাহউদ্দিন তাদের কর্তা হলে অবলীলায় মেনে নিয়েছে। এটাই চাকুরেদের কাজ। নুরুল ইসলাম অনু নামে একজন বিখ্যাত লোক আছেন। তিনি খুবই ভাগ্যবান। কয়েক বছর আগেও তার সঙ্গে অফিসার্স ক্লাবে এক বিয়েতে আমার দেখা। এক সময়ের খুব দক্ষ, যোগ্য অফিসার। ১৯৫৭-’৫৮ সালে পাকিস্তানে চাকরিতে যোগ দেন। সিএসপি ছিলেন কি না জানি না। তবে চাকরি পেয়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানের এপিএস বা পিএ টিএ কিছু হয়েছিলেন। দক্ষতার কারণে সব সময় গভর্নরের স্টাফ অফিসার হিসেবে কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় তিনি বঙ্গভবনে বেসামরিক একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরলে সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আসেন। আমাদের সঙ্গে তার অহরহ দেখা হতো। মধুর ব্যবহার করতেন। যোগ্য দক্ষ যে ছিলেন তাতো আগেই বলেছি।

তখন তো আর জানতাম না যে, আমরা যখন ঝাড়ে জঙ্গলে পাকিস্তানকে নিপাত করার জন্য যুদ্ধ করেছি, তখন এসব ভালো ব্যবহারকারীরা পাকিস্তান রক্ষায় আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। এখন যখন এগুলো ভাবি তখন বড় বেশি খারাপ লাগে। জেলখানা থেকে ফিরে দু’একদিনের মধ্যেই জনাব তালিম হোসেনের বিষয় নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়েছিলাম। তখন এখনকার মতো ছিল না। তখন লোকজন কথা শুনতো। বঙ্গবন্ধু তো শুনতেনই। তাই কবি তালিম হোসেনের কথা শুনে তিনি খুব বিস্মিত হয়েছিলেন এবং কয়েক দিনের মধ্যেই তার মামলা প্রত্যাহার করে তাকে মুক্তি দিয়েছিলেন।
এখনও সেই আগের মতো কত শত অসঙ্গতি দেখতে পাচ্ছি। যারা হাত-পা বেঁধে নেতা-নেত্রীদের ওয়ান-ইলেভেনে জেলে নিয়েছিল, জুলুম করেছে, প্রতিমন্ত্রী টুকুর মেয়েকে আসামি করেছে, ডিপজলের বউকে জেল খাটিয়েছে। এ সব কর্মকাণ্ডের হোতারা এখনও বহাল-তবিয়তে রয়ে গেছে। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় ছেলেমেয়ের জন্য সব বাবাই কিছু না কিছু বিষয় সম্পত্তি করে। ছেলেমেয়ে সাবালক হোক আর নাবালক হোক, অনেক ছেলেমেয়েই তা জানে না। এই তো দু’বছর আগেও আমি আমার দুই মেয়ে কুঁড়ি-কুশির জন্য আট লাখ টাকার জমি কিনেছি। কুশি তো মাত্র পাঁচ বছরের, কুঁড়ির বয়সও কুড়ি। এতে ওদের কি করার আছে? আমি যদি ট্যাক্স না দিয়ে থাকি অপরাধ আমার। এখানে কুঁড়ি-কুশির কি অপরাধ হতে পারে? আমরা একটি অতি সাধারণ পরিবার। আমি ছাড়া আমার পরিবারের এখনও কারও ব্যাংক অ্যাকাউন্টও নেই। ছেলে দীপের পঁচিশ বছর হয়েছে। ও কোনো ব্যাংক একাউন্ট করেছে কিনা জিজ্ঞেস করিনি, তাই জানি না। যদি করেও থাকে সে অ্যাকাউন্টে বিশ-পঞ্চাশ হাজার বা এক-দুই লাখের বেশি টাকা নেই। স্ত্রীর নামে কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই। দুই এক পাখি জমিজমা যা আছে তা আমার দেয়া। এ জন্য সে ইনকাম ট্যাক্স দিয়েছে কিনা এই অভিযোগ এনে তাকে জেলে পুরলে সেটা বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থারই একটা অপমান। বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় এখনও সাধারণ মানুষ ট্যাক্সের ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারেনি। সারা দিন-রাত যারা ঘুষ খায়, ঘুষ ছাড়া বেতনে যাদের সংসার চলে না তারা সাধারণ মানুষকে বলে দুর্নীতিবাজ। পাঁচ-সাত বছর আগেও আমার বিশ্বাস ছিল হালাল রুজি খাওয়ার অনেক মানুষ এখনও আছে। কিন্তু বৈধ আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের যে পার্থক্য তাতে ধীরে ধীরে এ বিশ্বাসটা একেবারে বিলীন হতে চলেছে। সাদা চোখে দেখা যাচ্ছে, যারা চাকরি-বাকরি করে তাদের বেতনের অর্ধেকেই অনেকক্ষেত্রে চাল-ডাল-নুন-তরকারির দামই হয় না। তারা বাসা ভাড়া দেয় কী করে? ছেলেমেয়ে পড়ায় কীভাবে? যাতায়াতের রাহা খরচা পায় কোথায়? আমি মোহাম্মদপুরে থাকি। এই তো চার-পাঁচ বছর আগেও এখান থেকে তিন-চার টাকায় মতিঝিল-গুলিস্তান যাওয়া যেত। এখন সেখানে পঁচিশ-ত্রিশ টাকা লাগে। একটা মানুষের অফিস যাতায়াতে যদি চার-পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয় তার তো সামান্য হাত খরচাও লাগে? এই ক’দিন আগে আমার এক ছোট্ট কর্মী করাতিপাড়ার শেফুল ইন্টারমিডিয়েট পাস করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে রংপুরে চাকরি নিয়েছে, তার বেতন সাত হাজার টাকা। খেতে লাগে চার হাজার, বাসাভাড়া দেড় হাজার। যাতায়াত এক হাজার, হাত খরচা, এরপর বাড়িতে কী পাঠাবে? বিয়ে করলে পরিবারের উপায় কী? আর আগে যে কোনো একজন চাকরিজীবী যে বেতন পেত একশ’, সোয়াশ’ বা দুশ’ টাকা তার বেতনের সিকিও খরচ হতো না। ছেলেমেয়ে স্ত্রী নিয়ে শহরে আরামে বাস করত। মাসে মাসে বাড়িতে টাকা পাঠাত বাবা-মার কাছে। তা দিয়ে তারা জমিজমাও কিনত। বেশিদূর যাব কেন? আমার শাশুড়ি আর গাড়ির চালক ইউসুফের কথা বলি। আমার শাশুড়ি টাঙ্গাইল কুমুদিনী কলেজের প্রিন্সিপাল নার্গিস হামিদ কোরায়শী উত্তর প্রদেশের আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কলকাতা হয়ে পঞ্চাশের দাঙ্গায় টাঙ্গাইল এসেছিলেন। কুমুদিনী কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে তিনি প্রথম প্রথম বেতন পেতেন চারশ’ পঞ্চাশ টাকা। প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করা, খাতাপত্র দেখা, জেলা পরিদর্শক হওয়া, অন্যান্য আরও দু’চারটি সরকারি কাজে অংশ নেয়ায় টিএ-ডিএ ভাতা মিলিয়ে মাসে আরও শতেক সোয়াশ’ টাকা বৈধপথে উপার্জন করতেন। বাড়িতে সব সময় পোলাও-কোরমা রান্না হতো। বাড়ির চারপাশ সে সুবাসে ম ম করতো। পরিবারের সবাই ভালো পোশাক-আশাক পরতো। তাতে তার মাসে খরচ হতো দেড়-দুশ’ টাকা। তিনি যে বাড়িতে থাকতেন তার পাশে প্রায় চল্লিশ ডিসিমেল জমি মাত্র দুশ’ টাকায় কিনেছিলেন। তারই কলেজে এক নিম্ন কর্মচারী কান্নাকাটি করায় দেলখোশ মনখোশের দাদাকে সাফকবালা দলিল করে দিয়েছিলেন। এখনও আমার শালা-সম্বন্ধীরা যে বাড়িতে থাকে, পিটি স্কুলের পাশে পঞ্চাশ-ষাট ডিসিমেল জমি আমার শ্বশুর আড়াই-তিনশ’ টাকায় কিনেছিলেন। আমার শশুর আবদুল হামিদ কোরায়শীর সারাজীবন রেশনের দোকান ছিল। সেখান থেকে তার প্রতি মাসে দেড়-দুশ’ টাকা অবলীলায় আয় হতো। কোরায়শী পরিবারের তখন মাসিক আয় ছিল সাত-সাড়ে সাতশ’ টাকা। খরচ হতো দেড় থেকে দুশ’। আগেই বলেছি, তখন দুশ’ টাকা হলে টাঙ্গাইল শহরে কোনো কোনো জায়গায় চল্লিশ শতাংশ জমি কেনা যেত। যার দাম এখন দুই-আড়াই কোটি টাকা। রোজগার করতেন সাড়ে সাতশ’। দান-ধ্যান করে পায়ের ওপর পা তুলে খরচ করতেন দুশ’। তাদের দৈন্যতায় পাবে কি করে? সংসারে টানাটানির প্রশ্ন কোথায়? আজ তো সবারই নুন আনতে পানতা ফুরায়। যারা কালো পয়সার স্তূপের ওপর বসে আছে তাদের কথা বাদ দিলে আর কারও কোন শান্তি নেই, স্বস্তি নেই। সব সময় একটা অস্বস্তি, একটা হাহাকার।

স্বাধীনতার পরপরই আমার গাড়ি চালাতো মটরার দুদু, মহেলার বাবু আর জাঙ্গালিয়ার ইউসুফ। তাদের বেতন ছিল দুশ’ থেকে আড়াইশ’ টাকা। ইউসুফ ছিল সবার ছোট। মনে হয় ইউসুফই দুশ’ টাকা বেতন পেত। বেশি দিন নয়, বাহাত্তর থেকে এক নাগাড়ে পঁচাত্তরের আগস্ট পর্যন্ত সে আমার কাছে ছিল। কত আর বেতন নিয়েছে। সাড়ে তিন বছরে সাত থেকে আট হাজার টাকা। আর এমনি এ সময় ও সময় বকশিশ টকশিশ তাও বড় জোর এক দেড় বা দু’হাজার টাকা। সব মিলিয়ে সাড়ে তিন বছরে তার বৈধ উপার্জন আট থেকে নয় হাজার বা বড় জোর দশ হাজার। কিন্তু সে ওই সময়ই গ্রামের বাড়িতে দু’ দুটা সুন্দর টিনের ঘর এবং সাত পাখি জমি খরিদ করেছে। এখন সে ধরনের দু’দুটা টিনের ঘর দিলে পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা খরচ হবে। আর সাত পাখি জমি কিনতে কমপক্ষে পঁচিশ-তিরিশ লাখ টাকা প্রয়োজন হবে। তাহলে তখন মানুষের উপার্জন আর ব্যয়ের সঙ্গে কত সুন্দর সাদৃশ্য ছিল। স্বাধীনতার পরপর মাননীয় মন্ত্রীদের বেতন ছিল দু’হাজার টাকা। কোনো কোনো মন্ত্রী মাসে হাজার টাকা খরচ করতে পারতেন না। ১৯৭২-’৭৩ সালে তখনও লিটার হয়নি, গ্যালন হিসেবে তেল বিক্রি হতো। পেট্রলের গ্যালন ছিল ছয় টাকা, ডিজেল দু’টাকা। মনে হয় পৌনে চার লিটারে গ্যালন। তখন গ্যালন যদি ছ’টাকা হয়, এখন লিটার আশি টাকা হলে তখন গ্যালন হওয়া উচিত ছিল তিনশ’ টাকা। স্বাধীনতার পরপর চাল ছিল আট আনা, দশ আনা। ১৯৭৩-’৭৪ সালে হঠাত্ করে বেড়ে তিন-চার টাকা সের হয়েছিল। আবার ’৭৫-এ দশ বারো আনায় নেমে আসে। সোনা নাকি এখন ষাট হাজার টাকা ভরি। স্বাধীনতার পর পর সোনা ছিল একশ’ চল্লিশ টাকা ভরি। আশি সাল পর্যন্ত সে মূল্য কখনও পাঁচশ’ টাকার নাগাল পায়নি। কথাগুলো বলছি এ জন্য যে, ’৭২-এ আমি যখন ঢাকায় আসি আমাদের বাড়িতে রাবণের চুলা জ্বলতো। প্রতি মাসে পনের-বিশ মণ চাল লাগত। বাজার করতে দু’তিনজনের দরকার হতো। মা বাসা চালাতেন। মাসে কখনও আড়াই হাজারের বেশি খরচ হতো না। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর আমরা যখন ভারতে নির্বাসিত তখন আমি থাকতাম মেঘালয়ে। মা-বাবা থাকতেন শিলিগুড়িতে। মাসে খরচ হতো তখনও হাজার দুই। এরপর আমরা বর্ধমানে চলে আসি। তারপর ’৮৪-তে আমার বিয়ে হয়। মা এক সময় বাংলাদেশে আসা-যাওয়া শুরু করেন। মা যখন বাসা চালান তখন ভালো চলে। মা চলে এলে নতুন বউ নাসরীন যখন চালায় কেমন যেন এলোমেলো। খরচ হয় দেড়গুণ, দুইগুণ। মা পাঁচ-ছয় হাজার টাকা দিয়ে যেভাবে বাসা চালান, নতুন বউ দশ হাজার দিয়েও পারে না। খাবার মানও ভালো না। ১৯৭৭-’৭৮ সালে মা-বাবা শিলিগুড়িতে থাকতে মাসে দু’তিন হাজার টাকা খরচ হতো। পনের-বিশজন খেত। চার-পাঁচ কেজি মাছ, মাংস আসতো। ১৯৮৪-’৮৫ এর দিকে বর্ধমানে থাকি। দশ-বারোজন খাই। আট-দশ হাজার টাকা খরচ হয়। কিন্তু মাছ-মাংস আসে তার অর্ধেক। খুব একটা বুঝতে পারি না। ’৮৬ সালের দিকে ৪৬ সদরঘাট রোডের বাড়ির পেছনের বাগানে মায়ের পাশে বসেছিলাম। আরও যেন কে কে ছিল। হঠাত্ বেগম সাহেব অভিযোগ করল, সে আর বাসা চালাতে পারবে না। আমিও কি করে যেন বলে বসলাম, ‘আচ্ছা’। তুমি দু’তিন হাজার টাকায় শিলিগুড়িতে বাসা চালাতে। খাবার-দাবার কত ভালো ছিল, কাপড়-চোপড় তেল-সাবান কোনো অভাব ছিল না। এখানে পাঁচ-ছ’হাজারে বাসা চলে যেত। বেগম সাহেব আট-দশ হাজারেও পারে না?’ মা বললেন, ‘সব জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। বউ কি করবে?’ আমি বললাম, ‘তাই বলে অত?’ মা বললেন, ‘ঠিক আছে।’ দেখি তো একটু হিসাব করে। বর্তমান প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদার রাজা, সখীপুরের লুত্ফর আরও কে কে যেন পাশে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল। কাকে যেন বলেছিলাম, আজ মনে নেই। খাতা কলম নিয়ে এল। মা একেক করে হিসাব লেখালেন। ’৭৭, ’৭৮-এ শিলিগুঁড়িতে রান্নার কয়লা ছিল আট টাকা মণ। ১৯৮৬-’৮৭ তে সেটা হয়েছে চল্লিশ টাকা। ’৭৮-এ মাছ মাংস ছিল তিন চার-টাকা কেজি। সেটা তখন ষোল থেকে আঠারও টাকা। সরিষার তেল ছিল দু’টাকা। সেটা হয়েছে ন’টাকা থেকে দশ টাকা। আদা, মরিচ, পিঁয়াজ, রসুন সবকিছুই এমনি তিন-চার-পাঁচগুণ, কোন কোনটা দশ গুণ বেশি। পরে অনেকক্ষণ হিসাব-টিসাব মিলিয়ে দেখলাম, ষাট থেকে আশি হাজার টাকা দিয়ে আমরা যেভাবে শিলিগুড়িতে চলতাম ওভাবে চলা যেতে পারে। কিন্তু বর্ধমানে আমি খরচ করি আট-নয় হাজার, টানাটানি তো থাকবেই।

ছোটবোন রহিমা সিদ্দিকীর বিয়ে হয়েছিল বাবর রোডের বাড়িতে। সে সময় তাকে বিশ-বাইশ ভরি সোনা দেয়া হয়েছিল। বিয়েতে উপঢৌকন পেয়েছিল আরও পঞ্চাশ-ষাট ভরি। আমাদের বিশ-বাইশ ভরিতে খরচ হয়েছিল চার হাজার টাকা। অন্যটা বলতে পারব না। টাঙ্গাইলের চমচমই এসেছিল না হলেও চল্লিশ মণ। লোকজন খেয়েছিল প্রায় তিন হাজার। মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর ভাই, সোহরাব হোসেন আরও অনেক মন্ত্রী এসেছিলেন। ভারতীয় রাষ্ট্রদূত শ্রী সুবিমল দত্ত এবং উপ-রাষ্ট্রদূত জেএন দীক্ষিত এসেছিলেন। তখনকার যুব নেতাদের মধ্যে তোফায়েল ভাই, আমু ভাই, মনি ভাই, রাজ্জাক ভাই কেউ বাদ ছিলেন না। নুরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কদ্দুস মাখন এসেছিলেন। রাজনৈতিক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি ছিল বলে আসম আবদুর রব ও শাহজাহান সিরাজসহ জাসদ নেতাদের পাওয়া যায়নি। জনাব জিয়াউর রহমান বীর উত্তম এসেছিলেন। সাফায়াত জামিল, খালেদ মোশারফ বীর উত্তমও এসেছিলেন, এসেছিলেন আরো অনেকে। সন্ধ্যার দিকে দোয়া করতে বঙ্গবন্ধু নিজে বাবর রোডের বাড়িতে এসেছিলেন। কামাল, জামাল, রাসেল তিনজনই ছিল। আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং রেহানা শরিক হয়েছিল কিনা বলতে পারবো না। কিন্তু তারা দু’বোন বাবর রোডের বাড়িতে পরম আত্মীয়ের মতো বেশ কয়েকবারই এসেছে। ’৯০-এর পরে বাবর রোডের বাড়িতে দীপ কুঁড়ির সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দারুণ সুন্দর সু্ন্দর অনেক ছবি আছে। লেখাটা লিখছি প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে ষড়যন্ত্র। সেখানে চাল ডাল বাজারঘাট এসব আলোচনায় আনায় অনেকেই হয়তো এটাকে অপ্রয়োজনীয় ভাবতে পারেন। আমার কাছে এই অসঙ্গতিকেই আলামত মনে হয়, সেই জন্যই আকাশছোঁয়া এসব অসঙ্গতি তুলে ধরছি। এ ধরনের লাগামহীন অসঙ্গতির মধ্য দিয়েই ষড়যন্ত্র সৃষ্টি হয়। আমি কোন বিশ্লেষক নই, কোন বিশেষজ্ঞও নই। সব সময় আমি আমার জীবন থেকে শেখার চেষ্টা করেছি, বিরাট ব্যবধান, বৈষম্য, মহাদুর্যোগের পূর্বাভাস দেয়। আমি ’৭৫-এর আগের সেই আলামত দেখতে পাচ্ছি বলেই কথাগুলো বলছি। এখানে আরও ছোট্ট দুটি ঘটনার উল্লেখ করছি। এক. ফরিদপুর সার্কিট হাউসে এক পিয়নের ধান ফলানো, অন্যটি রক্ষী বাহিনীর দুই পরিচালকের দেহরক্ষীর মল্লযুদ্ধ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন