শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১১

জ্বালানির দাম ভোগাবে সরকারকে


বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্য সমন্বয়, বিশেষ করে দাম বাড়ানো নিয়ে কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়েছে সরকার। দাম না বাড়ালে যে পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হয়, দীর্ঘদিন তা বহন করা অসম্ভব। আবার দাম বাড়ালে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে সমগ্র অর্থনীতিতে।
সরকারি সূত্রগুলো জানায়, এই উভয়সংকট সত্ত্বেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ানো ছাড়া কোনো উপায় নেই। সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে এগোচ্ছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বাড়া-কমার সঙ্গে সংগতি রেখে দেশেও নিয়মিত বিরতিতে মূল্য সমন্বয় করতে চাইছে।
এই উভয়সংকটের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় সাবেক অর্থসচিব ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খান সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের পরামর্শ দেন।
এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বলেন, সরকার দেশের জ্বালানি সম্পদ আহরণ ও ব্যবহারে দক্ষতার পরিচয় দিতে না পারায় জ্বালানি তেলের আমদানি গত দুই বছরে দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। ফলে জ্বালানি তেল আমদানির ব্যয় ও ভর্তুকির পরিমাণ সরকারের বহনক্ষমতার বাইরে চলে গেছে।

সূত্রগুলো জানায়, শিল্পে নতুন বিনিয়োগের গতি খুবই শ্লথ। এরও কারণ বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সংকট। একমাত্র চট্টগ্রামেই প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে স্থাপিত শিল্প জ্বালানির অভাবে চালু হতে পারছে না। ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র বিদ্যমান শিল্পও জ্বালানিসংকটের শিকার। এই অবস্থায় সরকারকে জ্বালানির সরবরাহ বাড়াতে হবে। কিন্তু সেখানে দেশীয় জ্বালানির পরিমাণ না বাড়ানো গেলে আমদানি ও ভর্তুকি বাড়তেই থাকবে।
আরও বাড়বে: সরকারি-বেসরকারি সূত্রগুলো জানায়, সরকারকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম আরও বাড়াতে হবে। কারণ সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধির পরও এই খাতে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি বহন করতে হবে। 
জ্বালানি তেল আমদানি ও বিপণনের দায়িত্ব পালনকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান মোক্তাদীর আলী প্রথম আলোকে বলেন, জ্বালানি তেলের সাম্প্রতিক দাম বাড়ানোর পরও এ বছর এই খাতে আয়-ব্যয়ের ঘাটতি হবে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান এ এস এম আলমগীর কবির বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর আগের হিসাব অনুযায়ী এ বছর বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি লাগত এক হাজার কোটি টাকার মতো। তেলের দাম বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তা প্রায় দেড় হাজার কোটিতে উঠেছে। এই অবস্থায় তাঁর দাবি শিগগির বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর।
সরকারি সূত্রগুলো জানায়, বিদ্যুতের পাইকারি দাম (বিতরণকারী সংস্থাগুলোর ক্ষেত্রে) শিগগির বাড়ানো হবে। গ্রাহক পর্যায়েও বাড়ানো হবে এ বছরের মধ্যেই। দাম বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন ব্যয়, জিনিসপত্রের দাম, জীবনযাত্রার ব্যয়ভার আরেক দফা বাড়বে। ফলে আর্থিক চাপ সাধারণ মানুষের জীবনকে আরও একটু কঠিন করে তুলবে।
প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন: গত রোববার সরকার যে প্রক্রিয়ায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে, তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব মহলে প্রশ্ন উঠেছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য দেশে একটি আইনি কাঠামো ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ২০০৩ সালের আইন অনুযায়ী, একটি নির্ধারিত প্রক্রিয়ার অধীনে এই কাজটি করার কথা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি)।  তা-ও করা হয়নি। বিইআরসির চেয়ারম্যান সৈয়দ ইউসুফ হোসেন বলেছেন, এবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত তাঁরা নেননি। 
বিষয়টি সম্পর্কে আকবর আলি খান বলেন, বিইআরসির প্রক্রিয়ার মধ্যে মূল্য সমন্বয় করা হলে উন্মুক্ত সভা, গণশুনানি প্রভৃতির মাধ্যমে সবাই জানতে পারত যে প্রকৃত পরিস্থিতি কী। বিপিসি যতটা ভর্তুকির কথা বলছে, সেটাই সঠিক কি না। বিপিসি যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে তেল আমদানি করতে পারছে, নাকি তাদের অদক্ষতার কারণে লোকসান ও ভর্তুকি বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞ অভিমত: বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্য সমন্বয়ের ফলে সৃষ্ট উভয়সংকট থেকে বের হয়ে আসার উপায় সম্পর্কে বিআইডিএসের মহাপরিচালক এম কে মুজেরি বলেন, প্রথমত, জ্বালানি ব্যবহারে পরিবহন ও উৎপাদন খাতের দক্ষতা বাড়িয়ে কিছুটা ভারসাম্য আনা যায়। দ্বিতীয়ত, প্রায় সব সময় দেখা যায়, জ্বালানির দাম বাড়ার কারণে পরিবহনের ভাড়া কিংবা কোনো কিছুর দাম যতটা বাড়ানো যৌক্তিক, তার চেয়ে অনেক বেশি বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এটা রোধ করা গেলে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে রাখা সম্ভব।
আকবর আলি খান বলেন, ‘জ্বালানির মূল্য সমন্বয়ের বিষয়টি সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে জাতীয় বাজেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে বিবেচনা করতে হবে। সংসদে আলোচনা করতে হবে। এখন বিষয়টি বাজেট থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। আমলাতন্ত্র যখন যেমন খুশি সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। সে কারণেই হঠাৎ করে ১৮ হাজার কোটি টাকা কোথায় পাব বলে দাম বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। অথচ ওই জ্বালানিপণ্যে সরকার কত হাজার কোটি টাকা শুল্ক ও কর আদায় করছে, সেটাও বলা উচিত। দরকার হলে শুল্ক ও কর কিছুটা কমিয়েও দাম কিছুটা কম রাখা যায়।’
আকবর আলি বলেন, সরকার দেশের জ্বালানি সম্পদের ব্যবহার বাড়াতে না পারায় জ্বালানির আমদানিনির্ভরতা বেড়েছে। এ ক্ষেত্রেও সরকার দক্ষতার পরিচয় দিতে পারছে না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন