শনিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১১

দিল্লির সামরিক ও নিরাপত্তা স্বার্থের গোলামি বাংলাদেশের ‘নিয়তি’ হতে পারে না

দিল্লি ও ঢাকার একটা নিশ্চয়-জ্ঞান হয়েছে। সেই জ্ঞান হোল বাংলাদেশ ও ভারতের ‘নিয়তি’ একই সূত্রে গাঁথা। ইংরেজিতে ব্যবহার করা হয়েছে shared destiny । এই নিয়তিবাদিতাকে আমরা ভবিষ্যত সম্পর্কে দুই দেশের একটা সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি বা আশাভরসা হিশাবে ব্যাখ্যা করতে পারতাম। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তা বুঝাবার জন্য আলাদা একটি কথা ব্যবহার করা হয়েছে : common vision। তাহলে শেয়ার্ড ডেসটিনি কথাটার মানে অন্য কিছু নয়। দুইয়ের ‘নিয়তি’ এক ও অভিন্ন­ এই সুনির্দিষ্ট অর্থেই কথাটা বুঝতে হবে। নিশ্চিত করেই বলা হচ্ছে ভারত ছাড়া বা ভারতের বাইরে বাংলাদেশের আলাদা বা নিজস্ব কোন ‘নিয়তি’ নাই। আগামি দিনে ভারত যা হতে চায় বা হবে আমরাও তা-ই হব। যদি ভারত যা হতে চেয়েও পারবে না, সেই ব্যর্থতাও আমাদের ‘নিয়তি’ হয়ে উঠবে। ভারতের সফলতা শুধু নয়, দুর্দশাও আমাদের পরিণতি হবে। ভারত ও বাংলাদেশ উভয়েরই কপালের লিখন একটাই। তাই কি? যদি তা-ই হয় তাহলে বাংলাদেশের আর আলাদা রাষ্ট্র হয়ে থেকে ঝামেলা বাঁধিয়ে লাভ কী? ভারতের অঙ্গীভূত হলেই তো সব কিছুই সরল হয়ে যায়।

সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখে দিল্লি ও ঢাকা ১২ অনুচ্ছেদের যে ফেন্সমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষর করেছে তার মুখবìেধ কথাটি বলা হয়েছে : ‘আমরা নিশ্চিত’ (convinced) হয়েই দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন স্তরের সহযোগিতার চুক্তি করছি যা “‘উন্নয়ন’ ত্বরান্বিত করবে এবং দুটো দেশের ‘উন্নয়নের আকাáক্ষা, একই নিয়তি এবং শান্ত ও সমৃদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ার সাধারণ স্বপ্ন vision) বাস্তবায়নে সক্ষম করে তুলবে”। ‘আকাáক্ষা’ ও ‘সাধারণ স্বপ্ন’ উল্লেখ করার পরে ‘একই নিয়তি’ কথা আলাদা ভাবে বলা হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের শাসক ও শোষক শ্রেণীর ‘উন্নয়নের আকাáক্ষা’-র মধ্যে মিল থাকতে পারে এবং দক্ষিণ এশিয়াকে সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ অঞ্চল হিশাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে উভয়ের একই স্বপ্ন থাকা অসঙ্গত কিছু নয়। কিন্তু ভারতের নিয়তির আমরা কিম্বা আমাদের নিয়তির ভারত অংশীদার এই সুনির্দিষ্ট চিন্তাও তাদের আছে এই দিকটা আমাদের জন্য নতুন। কূটনৈতিক বা দ্বিপাক্ষিক রাষ্ট্রনৈতিক চুক্তির দলিলে নিয়তিবাদী চিন্তা ঢুকে পড়াকে সহজ ভাবে নেবার উপায় নাই। রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়তিবাদী ধারণা দিয়ে বোঝার কুসংস্কার ও অযৌক্তিকতার খটকা তো আছেই। চুক্তির পেছনে দুটো স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের সম্পর্ক সম্বìেধ যে চিন্তা কাজ করেছে, সেই চিন্তার মতলবটা আসলে কী তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। একটা অস্বস্তি তৈরি হয়।
ফেন্সমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট বা নতুন ধরণের এই নিয়তিবাদী চুক্তির অনুচ্ছেদ এক আমাদের জানাচ্ছে যে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের করিডোর চুক্তি হয়ে গিয়েছে। কারণ এই চুক্তিতে উভয় দেশই ‘সম্মতি’ (HAVE AGREED...) ) জানিয়ে স্বাক্ষর করেছে। যে ভাষায় সেটা লিখিত হয়েছে সেখানে বেশ মুনশিয়ানা আছে। বলা হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত সড়ক দিয়ে, রেলগাড়ি করে, অভ্যন্তরীণ নদীপথে, আকাশে উড়োজাহাজে করে এবং জাহাজে ‘বাণিজ্য’ করবে। তার জন্য দরকারি অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে, সামুদ্রিক বন্দর ব্যবহার করা হবে, নানান কায়দায় পণ্য পরিবহন করা হবে এবং পরিবহনের উপায়গুলো ঠিকঠাক আছে কি না তার জন্য মানদণ্ডও তৈয়ার করবে। বাংলাদেশ ও ভারত বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়াতে চায়। এটা যে করিডোর দেওয়াই হচ্ছে তাতে যেন কোন সন্দেহ না থাকে তার জন্য বলা হয়েছে এই বাণিজ্য ‘দ্বিপাক্ষিক এবং উপ-আঞ্চলিক (ঢ়ৎদ-ড়পবমসষথল)’ হবে। অর্থাৎ তথাকথিত বাণিজ্যের ভূগোল ভারত, বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ভারতীয় রাজ্যের মধ্যে সীমিত থাকবে।
এবার আমরা করিডোর চুক্তিটি ইংরাজিতে কিভাবে লেখা হয়েছে সেটা এখন পড়ে দেখতে পারি।
ARTICLE 1: ÒTo promote trade, investment and economic cooperation, which is balanced, sustainable and builds prosperity in both countries. Both Parties shall take steps to narrow trade imbalances, remove progressively tariff and non-tariff barriers and facilitate trade, by road, rail, inland waterways, air and shipping. Both Parties will encourage the development of appropriate infrastructure, use of sea ports, multi-modal transportation and standardization of means of transport for bilateral as well as sub-regional use.Ó

এই ‘উপ-আঞ্চলিক’ কায়কারবার শুধু বাণিজ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। সাত অনুচ্ছেদ অনুযায়ী উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা (sub-regional cooperation) হবে ‘physical connectivity’’ বা ভূখণ্ডগত সংযোগের সুবিধা থেকে ফায়দা তোলার কাজে। একই ভাবে ফায়দা তোলা হবে বিদ্যুৎ খাত, পানিসম্পদ ব্যবস্খাপনা এবং ‘পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়ন’ মার্কা সুবিধা আদায়ের ক্ষেত্রেও। সকল ক্ষেত্রেই দুটো দেশ একসঙ্গে প্রকল্প বানাবে এবং যৌথ বিনিয়োগের ব্যবস্খা করবে। ভূখণ্ডগত সংযোগের ধারণাকে (physical connectivity’) খুব নির্দোষ ভাববার সুযোগ নাই, বিশেষত যদি তাকে ‘উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার’ (sub-regional cooperation) ধারণার সঙ্গে এক করে ভাবা যায়। এর মধ্য দিয়ে দিল্লির সামরিক ও নিরাপত্তা চিন্তার রণনীতি ও রণকৌশল ধরা পড়ে। দিল্লি চাইছে বাংলাদেশের ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী যে-সাতটি রাজ্য আছে সব মিলিয়ে এই পুরা ‘উপ-অঞ্চল’কে ভৌগোলিক ভাবে অভিন্ন গণ্য করে তার তিনটি উদ্দেশ্য সাধন। প্রথমে তার নিজ দেশের বিদ্রোহ মোকাবিলা; দুই, চিনের সঙ্গে সম্ভাব্য সংঘাত ও দ্বন্দ্বের কথা মনে রেখে সামরিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো তৈয়ার এবং তিন, ‘উপ-অঞ্চল’ নামে ভূগোল ও প্রাকৃতিক সম্পদ এলাকার সমৃদ্ধিকে ভারতীয় পুঁজির বিনিয়োগ ও মুনাফার কাজে খাটানো। আমরা জানি যে ইতোমধ্যেই সিলেটে ভারতের বিনিয়োগকারীদের জন্য ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে। সেটা আবার হচ্ছে ব্যক্তিগত খাত হিশাবে। সেখানে ভারতের বৃহৎ পুঁজির বিনিয়োগ হবে বলে ইতোমধ্যে প্রতিশ্রুতি পাওয়া গিয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে।
এবার ফেন্সমওয়ার্ক এগ্রিমেন্টের সাত নম্বর অনুচ্ছেদ ইংরাজিতে কিভাবে লেখা হয়েছে সেটা পড়ে দেখা দেখা যাক।
ARTICLE 7 : To harness the advantages of sub-regional cooperation in the power sector, water resources management, physical connectivity, environment and sustainable development for mutual advantage, including jointly developing and financing projects.

সাত অনুচ্ছেদের পরপরই আট অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “দুটো দেশ তাদের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে সহযোগিতা করবে”। এই ভাবে ‘জাতীয় স্বার্থ’ নিয়ে সাধারণ একটি অনুচ্ছেদ যুক্ত করাকে অর্থহীন মনে হতে পারে, কারণ যেকোন দ্বিপাক্ষিক চুক্তির ভিত্তি তো একমাত্র দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষার জন্যই। অতএব আলাদা করে মুখবìেধ না বলে হঠাৎ করে অন্য অনুচ্ছেদের মাঝখানে ‘জাতীয় স্বার্থ’ কথার উল্লেখ ভিন্ন অর্থ বহন করে। এখানে ‘জাতীয় স্বার্থ’ বলতে সামরিক ও নিরাপত্তা স্বার্থের কথাই বলা হয়েছে। বলাবাহুল্য, সেই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ‘জাতীয় স্বার্থ’ মানে ভারতীয় স্বার্থেরই অধীন একটা ব্যাপার মাত্র। সেটা রক্ষা হবে দুটো দেশ যদি স্খিতিশীল বা ‘শান্তির পরিবেশ’ বহাল রাখে যা দুই দেশের ‘অভিন্ন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন’ (inclusive economic growth and development) প্রক্রিয়া জারি রাখার জন্য দরকার। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যে বাণিজ্য ঘাটতি বা কূটনৈতিক ভারসাম্যহীনতা রয়েছে সেটা কমানোর কথা এক নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে (narrow trade imbalances)। সেটা করা হবে ভারতকে করিডোর দিয়ে। তাহলে ‘অভিন্ন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন প্রক্রিয়া’ কথাটার মানে আলাদা। তার মানে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভারতীয় অর্থনীতির অন্তর্ভুক্ত হওয়া ও করার কথাই এখানে বলা হচ্ছে। এই অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিও সামরিক ও নিরাপত্তার স্বার্থে। এর পরপরই নয় অনুচ্ছেদে সামরিক ও নিরাপত্তার কথা স্পষ্ট ভাবেই বলা হয়েছে। বলা হয়েছে এই ফেন্সমওয়ার্ক এগ্রিমেন্টের উদ্দেশ্য দুই দেশের ‘নিরাপত্তাসংক্রান্ত উৎকণ্ঠার’ ক্ষেত্রে পরস্পরের সহযোগিতা। বলা হয়েছে, ‘কোন পক্ষই অপরের জন্য ক্ষতিকর কোন কাজে তাদের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেবে না’। এর ইংরাজি ভাষ্য হচ্ছে এই রকম :
ARTICLE 9 : To cooperate on security issues of concern to each other while fully respecting each other’s sovereignty. Neither party shall allow the use of its territory for activities harmful to the other.
অনুচ্ছেদ এগারোতে বলা হয়েছে, আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক বিস্তার নিশ্চিত করবার জন্য এই সামরিক ও নিরাপত্তা চুক্তি আগামি দিনে আরো উঁচু স্তরে ‘উন্নীত, গভীর ও সম্প্রসারণ করা’-র জন্য সংশোধন করা যাবে। অর্থাৎ এখন চুক্তি যা আছে সেটাই শেষ নয়। আগামিতে আরো যুক্ত হবে।
এই চুক্তি থেকে ইচ্ছা করলেই বাংলাদেশ বেরিয়ে আসতে পারবে না। চুক্তির অধীনে যে যৌথ কমিশন ((Joint Consultative Commission) গঠিত হবে ১২ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সেই কমিশনের কাছে আগে লিখিত ভাবে নোটিশ দিয়ে জানাতে হবে। বেরিয়ে আসার যে কারণ সেই লিখিত চিঠিতে দেওয়া হবে সেটা বাংলাদেশ বললেই গৃহীত হবে না। যৌথ কমিশন বাংলাদেশ ঠিক কি বেঠিক বলল তার বাছবিচার করবে। পরিস্খিতির মূল্যায়ন হবে। যৌথ কমিশন এই ক্ষেত্রে একধরণের যৌথ সরকারের ভূমিকা পালন করবে। দুই রাষ্ট্রের ‘যৌথ সম্মতি’ ছাড়া বাংলাদেশের এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার কোন সুযোগ নাই। তর্কের খাতিরে বলা যায় চুক্তি অনুযায়ী ভারতেরও নাই। কিন্তু চুক্তি হয়েছে ভারতের সামরিক ও নিরাপত্তার স্বার্থে, চুক্তি থেকে দিল্লির বেরিয়ে যাবার কোন যুক্তি নাই। অন্যদিকে দিল্লি সামরিক ও অর্থনৈতিক সব দিক থেকেই শক্তিশালী। বাংলাদেশ চাইলেই বেরিয়ে আসতে পারবে তারও কোন সম্ভাবনা নাই। যদি কোন কারণে সেটা সম্ভবও হয় তারপরেও এই চুক্তির অধীন যা কিছু করা হবে বা যেসব উদ্যোগ বা প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে সেই সব থেকে যাবে। সেখানে কোন হেরফের হবে না।
অনুচ্ছেদ বারো এটাও পরিষ্কার করে বলছে যে, যেদিন এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে সেদিন থেকেই সেটা বলবৎ হয়েছে। অর্থাৎ সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখ থেকেই এই চুক্তি বলবৎ হয়ে গিয়েছে। ফেন্সমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট কোন প্রস্তাব নয়। এটা এখন ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বলবৎ চুক্তি। এই দিকটা বুঝতে পারা বাংলাদেশের জনগণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
চুক্তি প্রণয়নের প্রক্রিয়ার দিকে যদি আমরা খেয়াল করি তাহলে এই চুক্তি একান্তই শেখ হাসিনার নিজস্ব এজেন্ডা। যার কারণে তিনি পুরা কাজটিই করেছেন তার দুই উপদেষ্টার মাধ্যমে। তাকে দিয়ে এই চুক্তি করিয়ে নেবার পর এখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষেও আর তিস্তার পানি পাইনি বলে বেরিয়ে আসা অসম্ভব। এই ফাঁদে শেখ হাসিনা নিজেই স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছেন। তিনি তিস্তার পানি আদৌ পান কি না সেটাই সন্দেহ। যদি আদৌ পান তবে সেটা হবে ভারতীয় শর্তে এবং তাকে সেটা হজম করতে হবে। এখন পরিষ্কার হয়ে উঠছে যে সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল থেকেই শেখ হাসিনাকে দিয়ে এই চুক্তি করিয়ে নেবার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। চুক্তি স্বাক্ষর করবার পর মুহূর্ত থেকেই শেখ হাসিনা ও তার দুই উপদেষ্টার হাত থেকে চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষমতা জয়েন্ট কন্সালটেটিভ কমিশনের হাতে চলে গিয়েছে। বিচিত্র ব্যাপার হচ্ছে এই ধরনের কোন কমিশন এখনো গঠিতই হয় নি। স্বচ্ছভাবে দেনদরবার শলাপরামর্শ করার জন্য আগেই কোন যৌথ কমিশন বা দ্বিপাক্ষিক পরামর্শ কমিশন গঠন করা হয় নি। এখন যৌথ কমিশনের নামে মূলত ভারতের সামরিক ও নিরাপত্তা স্বার্থ রক্ষার জন্য এক ধরণের ‘যৌথ সরকার’ গঠিত হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর দিল্লির সঙ্গে যে সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করে এসেছেন, তখন থেকেই আমি বারবারই বলে এসেছি দিল্লি বাংলাদেশের সঙ্গে মৈত্রী চায় না। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জনগণ দিল্লির সামরিক ও নিরাপত্তা নীতির গোলামি করুক এটাই প্রধান উদ্দেশ্য। জানুয়ারি দুই হাজার দশে শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে যে যৌথ বিবৃতি দেওয়া হয়েছিল তারও ভারকেন্দ্র ছিল ভারতের সামরিক ও নিরাপত্তার প্রশ্ন। গোলামির দাসখৎ হিশাবেই ফেন্সমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট-কে দেখতে হবে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্খার মধ্যে পরাশক্তি
হিশাবে ভারতের আবির্ভাবের দৃশ্যমান প্রমাণ হয়ে উঠেছে এই চুক্তি।
এখন প্রশ্ন উঠবে দিল্লির গোলামিতে কি আমাদের কোনই উপকার নাই? অবশ্যই আছে। ইংরেজের দুই শ’ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের কোন ফল কি আমরা পাই নি? অবশ্যই পেয়েছি। রেলপথ হয়েছে, টেলিগ্রাফ হয়েছে, ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক ব্যবস্খা পেয়েছি আমরা, ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছি। মনিব হিশাবে দিল্লি ইংরাজের চরিত্র নিয়ে হাজির হবে না ঠিক, কিন্তু দিল্লির গোলামি করে একদমই ফায়দা নাই, এই দাবি আমি করবো না। প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কি আদৌ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র? আমরা কি রাজনৈতিক ভাবে নিজেদের একটি স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠী গণ্য করি, নাকি করি না? আমাদের কি কোন রাজনৈতিক ইতিহাস ও অস্তিত্ব বলে কিছু নাই? ইংরাজের এত অবদানের পরেও এই দেশে সিপাহি বিদ্রোহ হয়েছিল, জমিদার-মহাজন-ইংরাজের বিরুদ্ধে কৃষক বিদ্রোহ হয়েছিল। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলন হয়েছিল এবং ইংরাজ সেই স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয়েছিল। দিল্লির বিরুদ্ধেও হবে। সেটা আগামি দিনে আমরা দেখব। এর অন্যথা হবে বলে মনে করবার কোন কারণ নাই। এই চুক্তির মধ্য দিয়ে নব্য আঞ্চলিক গোলামির নতুন ঐতিহাসিক কালপর্বে আমরা প্রবেশ করলাম। দিল্লির গোলামির তত্ত্ব এই কথা বলে ফেরি করা হয় যে বাংলাদেশের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় হবে না সেটা হবে অর্থনৈতিক। দিল্লির সঙ্গে আমাদের আদানপ্রদানে আমাদের খালি অর্থনৈতিক হিসাব কিতাব করতে হবে। আমরা যে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র এই সত্য আমাদের ভুলে যেতে হবে। যারা আমাদের এই সত্য ভুলিয়ে দেবার জন্য আদাজল খেয়ে নেমেছেন তাদের চিনতে আমাদের ভুল হওয়া উচিত নয়।
এই চুক্তি শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত হলেও তার পক্ষে কোন জনমত নাই এটা বলা যাবে না। বাংলাদেশে অবশ্যই দিল্লির অর্থনৈতিক, সামরিক ও নিরাপত্তার স্বার্থ রক্ষা করবার লোকের অভাব নাই। এই ধারা দিল্লির গোলামির পক্ষে জনমত তৈরি করবার জন্য দীর্ঘদিন ধরে প্রচার করছে যে ভারতের বিরোধিতা করা হয় সাম্প্রদায়িক প্রণোদনায়। ভারতীয় ‘জুজু’-র ভয় দেখিয়ে বাংলাদেশকে দিল্লির পরাধীন করবার মহৎ উদ্দেশ্যে নাকি বাগড়া দেওয়া হয়েছে। জনগণ দিল্লির সদিচ্ছা সম্পর্কে বিভ্রান্ত হয়েছে। এখন আমাদের অসাম্প্রদায়িক প্রমাণ করবার জন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যেকোন মূল্যে হোক বাংলাদেশকে দিল্লির শাসকদের হাতে তুলে দিতে হবে। এর মধ্য দিয়েই দুই দেশের ‘ঐতিহাসিক’ সম্পর্কের গুণগত উত্তরণ ঘটবে। সাম্প্রদায়িকতারও পরাজয় ঘটবে। এরা প্রচার করে বেড়াচ্ছিল যে বাংলাদেশ যদি ভারতের নিরাপত্তাসংক্রান্ত উৎকণ্ঠায় ঠিকভাবে সাড়া দেয় এবং বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়ের জন্য যে সকল রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী লড়াই করছে তাদের বাংলাদেশে জায়গা না দেয় এবং দিল্লির হাতে তুলে দেয়, তাহলে দিল্লির কাছে আমরা যা চাইব তাই পাবো। দিল্লির নিরাপত্তা বিভাগের কাজ অবশ্য গত বছর শেখ হাসিনা দিল্লি যাবার আগেই সম্পন্ন করে গিয়েছিলেন। প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছেন। কিন্তু পালটা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যখন বাংলাদেশে এলেন তখন বাংলাদেশের সবচেয়ে সংবেদনশীল চাওয়াটাই শেখ হাসিনা পেলেন না। ড. মনোমোহন দিতে পারলেন না। তিস্তার পানি পাওয়া গেল না। শুধু দু:খ প্রকাশ করলেন। দোষ চাপালেন পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির ওপর। বাংলাদেশের অধিকার, যেমন তিনবিঘা করিডোর পাওয়া, সেটাও আমরা পাই নি। বরং কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যে তিন বিঘা করিডোর ২৪ ঘন্টা খোলা রাখা হবে। এটা কে চেয়েছে? তিনবিঘা চাইবার বিষয় নয়। দিল্লি যেন আমাদের দয়া করছে। ভারতের সঙ্গে এই ব্যাপারে চুক্তি হয়ে আছে এবং চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ বেরুবাড়ি হস্তান্তর করলেও ভারত তিনবিঘা দিচ্ছে না। সেটা দিল না তো দিলই না। এবারও দিল না। এখন আবার খবর কাগজে দেখলাম সেখানে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হচ্ছে।
অতীতে ভারতের বিরোধিতার পেছনে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি কাজ করে নি, এটা আমরা বলি না। এখনো নাই এই সাফাই গাওয়াও অর্থহীন। ভারতের হিংস্র হিন্দুত্ববাদ ও প্রকট সাম্প্রদায়িকতার প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশে অনেক সময় কাজ করে। কিন্তু সেটা সবসময় গৌণ একটি ধারা। বাংলাদেশের জনগণ এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন। কিন্তু যারা দিল্লির গোলামি মেনে নিতে জনগণকে প্ররোচিত করে তারা আসলে এই রাজনৈতিক সত্য আড়াল করতে চায় যে বাংলাদেশের জনগণের দিল্লির বিরোধিতা সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ের অংশ নয়। এটা ভারতীয় জুজুর ভয়। অথচ এই লড়াই শুধু বাংলাদেশের নয় বরং পুরা উপমহাদেশের গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রামের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন। যে কারণে ভারতের জনগণের সঙ্গে গণতান্ত্রিক মৈত্রী আমাদের রচনা করতেই হবে। এর অন্যথা হলে চলবে না।
বলাবাহুল্য, ভারতের জনগণের সঙ্গে গণতান্ত্রিক মৈত্রী রচনা ও দিল্লির গোলামি মেনে নেবার ফেরেববাজি এক কথা নয়। এই সহজ সত্যও আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে একটি রাষ্ট্রের চোখে অন্য সকল রাষ্ট্র সবসময়ই সম্ভাব্য শত্রু। যদি রাষ্ট্র হিশাবে ভারতকে আমরা বিচার করি, তাহলে ভারত আমাদের মিত্র এই চিন্তা রাষ্ট্রনৈতিক অজ্ঞানতা ও বালখিল্যতা। শুধু ভারত নয়, দুনিয়ার যেকোন রাষ্ট্রই রাষ্ট্র হিশাবে বাংলাদেশের ‘সম্ভাব্য’ শত্রু। যদি রাষ্ট্র হিশাবে বাংলাদেশের টিকে থাকার কোন রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রনৈতিক তাৎপর্য আছে বলে আমরা মানি বা সচেতন থাকি তাহলে সকল রাষ্ট্রের বিপরীতেই বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিশাবে নিজের সার্বভৌমত্ব ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হবে। বাংলাদেশ সে কাজে সক্ষম হবে কি না সেটা নির্ভর করবে বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতার ওপর। সেই সচেতনতার মাত্রা বুঝবার একটি মানদণ্ড হতে পারে যারা সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরোধিতাকে ভারতীয় জুজুর ভয় বলে প্রচারণা চালায় তাদের সম্পর্কে জনগণের হুঁশিয়ার থাকার মাত্রার অপর।
ফেন্সমওয়ার্ক এগ্রিমেন্টের মত দিল্লির সঙ্গে স্বাক্ষর করা প্রতিটি প্রটোকল ও সমঝোতা স্মারক আলাদা আলাদা ভাবে পর্যালোচনার দাবি রাখে। একটি উদাহরণ দিয়ে এই লেখাটি শেষ করব। সীমান্তসংক্রান্ত একটি চুক্তি বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত স্বাক্ষর করেছে ১৯৭৪ সালে। এই চুক্তির অভিন্ন অংশ হিশাবে নতুন একটি প্রটোকল স্বাক্ষর করা হয়েছে। পুরানা চুক্তির সম্প্রসারণ হিশাবে এই নতুন প্রটোকল। এই প্রটোকলে নতুন উপাদান যুক্ত হয়েছে। চুক্তি ও প্রটোকল অনুযায়ী সীমান্ত চিহ্ন নির্দিষ্ট করা হয়েছে। অথচ সীমান্ত চুক্তি হওয়ার পরেও বাংলাদেশের ওপর অনেক ক্ষেত্রে ভারতীয় নাগরিকদের অধিকার মেনে নেওয়া হয়েছে, যা বিস্ময়কর। পীরদিওয়া ও পাদুয়া এলাকায় পীরদিওয়া গ্রামের ভারতীয় নাগরিকদের পিয়াং নদী থেকে পানি তুলে নেওয়া বা ব্যবহারের অধিকার মেনে নেওয়া হয়েছে। (ÒThe Parties agree that the Indian Nationals from Pyrdiwah village shall be allowed to draw water from Piyang River near point No 6 of the agreed Map.) এই পয়েন্টে ভারত যদি পাম্প বসিয়ে নদীর সব পানি টেনে নিয়ে যায়, তাহলে বলার কিছুই নাই। এটা ভারতীয় নাগরিকদের অধিকার। মুক্তাপুর/দিবির হাওর এলাকা সম্পর্কে বলা হয়েছে ভারতীয় নাগরিকরা বাংলাদেশের সীমান্তের মধ্যে কালী মন্দির দর্শনে যেতে পারবেন এবং পানি তুলে নিতে ও মাছ ধরতে পারবেন।The Parties agree that the Indian nationals shall be allowed to visit Kali Mandir and shall also be allowed to draw water and exercise fishing rights in water body in the Muktapur Dibir Hawor area from the bank of Muktapur side.)। মন্দির দেখতে আসা এক কথা, কিন্তু সীমান্ত ভাগ হওয়ার পর বাংলাদেশের জলমহালে ভারতীয় নাগরিকদের মাছ ধরার অধিকার স্বীকার করা কেমন চুক্তি? জলমহাল যদি বাংলাদেশের সীমান্তের মধ্যে পড়ে তাহলে সেখানে ভারতীয় নাগরিকরা ‘মাছ ধরার অধিকার’ কিভাবে পেতে পারেন? সেই ‘অধিকার’ নিশ্চিত করবার জন্য অবশ্যই ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর পাহারাও পাবেন ভারতীয় নাগরিকরা। এর মধ্য দিয়ে সীমান্ত সংঘর্ষের বীজও বপন করে রাখা হোল।
যদি সীমান্ত চিহ্নিত হয়েই থাকে তাহলে বাংলাদেশের ভূখণ্ড, নদী, হাওর বা স্খাপনা ভারতীয় নাগরিকদের ব্যবহার করতে দেবার যুক্তি কি? যদি দুই দেশের মৈত্রী সত্যি সত্যিই আমরা চর্চা করতে চাই তাহলে সীমান্তের দুই দেশের জনগণ সীমান্ত নির্দিষ্ট হয়ে যাওয়ার পরেও বাংলাদেশের মন্দিরে যাবার সুযোগ ভোগ করতেই পারেন। সেটা সীমান্ত পর্যায়ে অনুমতিসাপেক্ষে হতেই পারে। কিন্তু সেটা ভারতীয় নাগরিকদের ‘অধিকার’ হিশাবে প্রটোকলে লিখিত রাখবার প্রয়োজন কেন? তাছাড়া পানি তোলা, ব্যবহার ও মাছ ধরার ‘অধিকার’ কিভাবে ভারতীয় নাগরিকরা পেতে পারেন? বাংলাদেশের নাগরিকদের ক্ষেত্রে এই রকম কোন অধিকারের স্বীকৃতি এই প্রটোকলে নাই। যদি সীমান্তে ভারতীয় নাগরিকদের এই ‘অধিকার’ আমরা মানি তাহলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সেই অধিকার কোন যুক্তিতে খাটবে না বলে আমরা দাবি করব? কেন একজন ভারতীয় নাগরিক পাসপোর্ট ভিসা ছাড়া ঢাকার কালী মন্দিরে আসতে পারবেন না?
দিল্লির সঙ্গে চুক্তি করে মৈত্রী রচনার যে কেচ্ছাকাহিনী আমরা শুনি সেই মৈত্রীর চরিত্র এইসব নজির থেকে অনায়াসেই আন্দাজ করা যায়। আমাদের স্পষ্ট হতে হবে আমাদের নিয়তি ভারতের নিয়তি নয়। বাংলাদেশ ভারত ও চিনের মাঝখানে রয়েছে। সেই কারণে দিল্লির বিরোধিতা করতে গিয়ে অনেক সময় চিনের কোলে গিয়ে বসবার কথাও অনেকে বলেন। পূর্বমুখী নীতির কথা অনেক সময় ফেরি করতে গিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে চিনকে খাড়া করবার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশকে নিজের ভবিষ্যৎ নিজেকেই গড়তে হবে। যে দেশের নাগরিকরা নিজেদের সামরিক ও নিরাপত্তা স্বার্থের স্বাতন্ত্র্য ও অনন্য চরিত্র সম্পর্কে ভাবতে অক্ষম অন্যের গোলামিই তাদের পরিণতি হয়ে দাঁড়ায়।
আশা করি বাংলাদেশের জনগণ নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেরা গড়বার শক্তি অর্জন করবার সাধনা করবে। কারো গোলামি নয়।
farhadmazhar@hotmail.com
১৫ সেপ্টেম্বর ২০১১। ৩১ ভাদ্র ১৪১৮।
আরশিনগর।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন