রবিবার, ৪ জুন, ২০১৭

পার্বত্য চট্টগ্রামকে আমরা কোথায় নিয়ে চলেছি?


এক. 
পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে এখন বাঙ্গালিরা সেই ভুল করছে কি না-- যা পাঞ্জাবিরা করেছিল পূর্ব-পাকিস্তানে; কাশ্মীরে করছে ভারত, বালুচিস্তানে করছে পাকিস্তান, চীন করছে কাশগরে, বর্মা করছে আরাকানে, সিংহলিরা করেছে তামিলদের সঙ্গে?
দক্ষিণ এশিয়ায় এইরূপ ভুলের প্রথম ফল ছিল পূর্ব-পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে যাওয়া। কিন্তু বাংলাদেশ নিজের সংগ্রামের ঐতিহাসিক শিক্ষাটুকুই ভুলতে বসেছে। 
এটা আত্মঘাতি। 

দুই.
আমার যেসব বন্ধু ফিলিস্তিনী, রোহিংগা, কাশ্মীরী বা উইঘুরদের ন্যায়বিচারের দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল এবং সেখানে ন্যায্যতা দেখেন-- লংঘদু’র ঘটনায় তাদের ‘বাঙ্গালি হয়ে যাওয়া’য় দুঃখ পেলেও বিস্মিত হইনি। মাঠের খবরও এরকম যে, সারা দেশে তিক্ততা থাকলেও লংঘদুসহ পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামেই আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামায়াত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাহাড়িদের মোকাবেলায় শামিল। কিন্তু গভীর আত্মজিজ্ঞাসা প্রয়োজন, পার্বত্য লীগ-বিএনপি-জামায়াত ঐক্যের কাফেলা সেই ভুলের জন্ম দিতে যাচ্ছে কি না-- যা উর্দুভাষীদের একাংশ পূর্ববাংলায় করেছিল একাত্তর সালে?
কথিত যুবলীগ নেতাকে কে হত্যা করেছে সে বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই অসংখ্য গ্রামের শত শত পাহাড়ি নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে বিচার বহির্ভূত পন্থায় শাস্তি দেয়ার দায় কার? আন্তর্জাতিক পরিসরে এই প্রশ্ন উঠলে আশা করি, আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামায়াত মিলে সদুত্তর দেবেন।

তিন.
বর্তমান বিশ্ব একটা গ্রামের মতো। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙ্গালি-মুসলমানদের এটা ভুলে যাওয়ার অবকাশ নাই যে, লংঘদুর ঘটনার সরাসরি প্রতিক্রিয়া ঘটবে শ্রী লঙ্কার বাত্তিকালোয়া-ত্রিংকোমালেতে, বর্মার আরাকানে, চীনের উইঘুরদের জনপদে এবং ভারতের লাদাখে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙ্গালি মুসলমানরা লংঘদুর মতো ঘটনা যত ঘটাবেন--দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য স্থানে ‘প্রবল সংস্কৃতি’র বিরুদ্ধে মুসলমানদের স্বাধীকারের ন্যায্য সংগ্রামগুলো তত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 
বস্তুত জাতিগত ফ্যাসিবাদই আজ দক্ষিণ এশিয়ার মূল ব্যাধি। সামাজিক ন্যায় বিচারের সংগ্রামে জাতিতে-জাতিতে মৈত্রীর সম্ভাবনাটুকু এখানে এসেই থমকে যাচ্ছে। উল্টো ব্যাপক বিস্তৃত এক হানাহানির যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে পুরো অঞ্চল। বাংলাদেশকে প্রায় জোর করেই যেন সেই পরিসরে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। 

চার.
মূলত বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসনপদ্ধতির আকাল এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিসমূহের দুর্বলতা-দ্বিধাবিভক্তি-আদর্শিক দেউলিয়াত্ব পাহাড় ও সমতল সব জায়গার জাতিগত ও ভাষাগত সংখ্যালঘুদের জন্য পরিস্থিতি বিপর্যকর করে তুলেছে। বলা যায়, বাংলাদেশের রাষ্ট্রনৈতিক সংকটের সবচেয়ে খারাপ অভিঘাতটি পড়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। 
ত্রিধারায় বিভক্ত পাহাড়িদের মাঝে ভাতৃঘাতি বৈরিতাও তাদের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক অবস্থানকে দুর্বল করেছে। অনুমান করা যায়, এসবের মিলিত ফল হিসেবে সেখানে অবাঙ্গালিদের আসন্ন দিনগুলোতে আরো বিপর্যয়কর অবস্থায় পড়তে হতে পারে। তৃতীয় বিশ্বে এটা প্রায় পরীক্ষিত এক অভিজ্ঞতা, কর্তৃত্ববাদী কেন্দ্রীভূত শাসন চূড়ান্ত পর্যায়ে জাতিগত উম্মাদনা উস্কে দেয়।
চাকমা-মারমা-ত্রিপুরা নেতৃবৃন্দের জন্য সামনের দিনগুলো চালেঞ্জিং। তরুণদের নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদের ধারায় আটকে রাখা এবং এনজিও মানবাধিকার ব্যবসায়ীদের দুষ্টছায়া এড়িয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তির (যা প্রায় অবলুপ্ত হতে চলেছে) সঙ্গে মৈত্রীর পরিসর বাড়ানো দুরূহ এক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। 
বিশেষত যখন লংঘদুর মতো উস্কানিমূলক ঘটনাগুলো ঘটতেই থাকবে।

পাঁচ.
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশে সামরিকায়নের জন্য শাসক শ্রেণীর এক দারুণ উপলক্ষ্য। এবারের বাজেটেও রাষ্ট্রীয় ২,৯৩,৪৯৪ কোটি টাকা আয়ের বিপরীতে নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট খাতগুলোতে সম্মিলিত ব্যয় ছিল প্রায় ৪৫,০০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ বাংলাদেশে জাতীয় আয়ের প্রায় পাঁচভাগের এক ভাগই এখন নিরাপত্তা আমলাতন্ত্রের প্রয়োজনে যাচ্ছে। এইরূপ বরাদ্দের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহুধরনের কেনাকাটা--যা শাসকএলিটদের অত্যন্ত আগ্রহের বিষয়। কর্তৃত্ববাদী শাসন সংস্কৃতিতে এইরূপ ব্যয়ভারের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ না থাকলেও যেকোন জবাবদিহিমূলক শাসনামলে তা উঠবে বৈ কি। পার্বত্য চট্টগ্রাম এইরূপ ব্যয়ভারের অন্যতম যৌক্তিক পাটাতন হিসেবে কাজ করে। বস্তুত এভাবেই বর্মায়, শ্রী লঙ্কায়, ভারতে এবং পাকিস্তানে বিশেষ বিশেষ অঞ্চলকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে সামরিকায়ন ঘটেছে এবং ঘটছে। এরূপ সামরিকায়নের লাগাম টেনে না ধরতে পারলে এক সময় তা আত্মবিনাশী রূপ নেয়। ফলস্বরূপ বর্মা, শ্রী লঙ্কা, ভারত ও পাকিস্তান আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে এখন মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অভিযোগের মুখোমুখি প্রতিনিয়ত। ভূ-রাজনীতির যেকোন ওলোটপালটে এসব অভিযোগ কীভাবে ভিন্নরূপ নেয় তার নজির পূর্ব-তিমুর, তার নজির দক্ষিণ সুদানসহ আরও বহু অঞ্চল।
জাতীয়তাবাদী উগ্রতা বাংলাদেশকে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বিপদের দিকে ঠেলে দেয়া বিচিত্র নয়। 
ছয়.
১৯৪৭-৪৮ এ ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তি যখন দক্ষিণ এশিয়া ছেড়ে যায় তখন এ অঞ্চলের সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশ ছিল শ্রী লঙ্কা। সম্প্রতি বাংলাদেশের লংঘদুতে যা ঘটেছে ১৯৮৩ সালে জাফনায় এইরূপ এক ঘটনা থেকেই শ্রী লঙ্কা প্রায় ২৬ বছরের জন্য সিংহলি-তামিল রক্তক্ষয়ি বিবাদে জড়িয়ে ধ্বংসের কিনারে উপনীত হয়। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বর্মার বৌদ্ধ উগ্রবাদীদের একগুঁয়েমি পুরো দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাকে চড়ায় আটকে রেখেছে। কাশ্মীরে মাত্র ৬০ লাখ মানুষকে ১০ লাখ সৈন্য দিয়েও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না দিল্লি। বালুচিস্তান পাকিস্তানকে আরেকবার খন্ডিত হওয়ার সম্ভবনা জিইয়ে রেখেছে।

চারপাশের এসব অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শেখা দরকার।

ALTAF PARVEZ·SUNDAY, JUNE 4, 2017

সোমবার, ২৯ মে, ২০১৭

ট্রাম্পের সৌদি সফর ও ইরান প্রসঙ্গ

চলতি মে মাসের ২০-২১ তারিখে আমরা আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দেখতে পেলাম এক রাজকীয় সফরে সৌদি আরবে। সেই একই ট্রাম্প, যিনি গত ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্টের শপথ নিয়েই তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ‘মুসলিম ব্যান’ বাস্তবায়নে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন, মুসলমানদের আমেরিকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করবেন। সেটা মুরোদে না কুলালেও অন্তত সাত মুসলমান দেশ থেকে রওনা দিয়ে এসে আমেরিকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছিলেন তিনি। তবে তিনি তার এই আদেশ টিকাতে পারেননি। আদালতে চ্যালেঞ্জ হয়ে এটা রদ হয়ে যায়, পরপর দু’বার। সেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সৌদি আরব সফরে গেছেন। সবই ভাগ্যের পরিহাস! কারণ প্রেসিডেন্ট হিসাবে তার প্রথম বিদেশ সফর এই সৌদি আরবেই। কেন এই সফর?
মাত্র ২৫ বছর ব্যবধানের দুই বিশ্বযুদ্ধ দুনিয়ার ইতিহাস ভুগোলের আগা-পাশ-তলা বহু কিছুই উল্টেপাল্টে দিয়েছিল। বিশেষ করে ইসলামি জনগোষ্ঠীর সর্বশেষ খলিফার শাসনাধীন অটোম্যান সাম্রাজ্যকে প্রথমে ভেঙে দুই বড় টুকরোয় ভাগ করে নিয়েছিল ব্রিটিশ আর ফরাসি সরকার। এরপর দুই অংশেরই তস্য টুকরো টুকরা করা শুরু করেছিল। ব্রিটিশ অংশ থেকে এক বড় টুকরা ভাগ নিয়ে আজকের রাজতান্ত্রিক সৌদি আরব রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা (আবদুল-আজিজ আল-সৌদ) ইবনে সৌদের হাতে এর শুরু হয়েছিল ১৯৩২ সালে। অবশ্য আমেরিকার সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্কের শুরু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রায় শেষে, ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে। বিশ্বযুদ্ধের প্রায় শেষের দিকে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট মিসর সফরে এসে কিছু আরব নেতার সাথে দেখা করেছিলেন। সে সময় বাদশাহ ইবনে সৌদ আর প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের মধ্যে প্রথম শীর্ষ বৈঠক হয়েছিল সুয়েজ খালে নোঙর করা আমেরিকান যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস কুইনসে বসে। সৌদি-মার্কিন সম্পর্ক অনেক পুরনা, সৌদি আরবের জন্মের মাত্র ১৩ বছর পর থেকে যা এখনও বর্তমান। সিঙ্গাপুরের প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ‘এশিয়ান টাইমস’ গত ১৮ মে সংখ্যায় এসব পুরনো ইতিহাস স্মরণ করেছে। 
এক রাজকীয় রেওয়াজের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, সৌদি বাদশাহ এক কাপ কড়া সৌদি কফি পান করতে দিয়েছিলেন তার বিশেষ অতিথি প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে। প্রেসিডেন্ট শান্তভাবে সে কফি পান করার পরে রাজা ওই কাপ মেঝেতে আছড়ে ভেঙে ফেলে বলেছিলেন, ‘আপনি আমার কাছে খুবই বিশেষ একজন। তাই এই কাপ আপনার পর আর কেউ যেন ব্যবহার করতে না পারে তাই ভেঙে ফেললাম।’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই নায়ক রুজভেল্ট দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণে ওই সফরের দু’মাসের মাথায় সিটিং প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায়ই মারা যান; তবু বলা যায়, এই রিচুয়াল দিয়ে সৌদি-আমেরিকান সম্পর্কের যাত্রা শুরু হয়েছিল তা ভালোভাবেই কার্যকর হতে পেরেছিল। এশিয়ান টাইমস লিখছে, ‘ইবনে সৌদের সাথে রুজভেল্টের চুক্তি হয়েছিল যে, সৌদি তেলের বিনিময়ে আমেরিকা ইবনে সৌদ ও তার উত্তরাধিকারীদের সৌদি সরকারগুলোর সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করবে।’ পরে এই সম্পর্ক আরেক উঁচুপর্যায়ে পৌঁছেছিল প্রেসিডেন্ট নিক্সনের আমলে ১৯৭৪ সালে। বলা ভালো, ১৯৭৩ সালের অক্টোবর শেষ আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে আরবদের হার হয়েছিল আর এর প্রতিক্রিয়ায় পরের ছয় মাস ধরে তেল অবরোধ চলেছিল।
ইসরায়েল সমর্থক আমেরিকা ও তাদের বন্ধু অন্য রাষ্ট্রগুলোকে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে রাখা হয়েছিল এই তেল অবরোধে। এই অবরোধের সমাপ্তিতে নতুন চুক্তি করার ক্ষেত্রে সৌদি-আমেরিকা পরস্পরের প্রয়োজন পূরণের ক্ষেত্রে আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ পার্টনার হিসেবে অনুভব করেছিল। নিক্সন ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে সৌদি সফরে গিয়ে তাদের সেই সম্পর্ক আরো পাকা করেছিলেন। ফলে সৌদি আরবের মনে হয়েছিল আমেরিকান প্রটেকশনের প্রতিশ্রুতিতে রাজশাসন ব্যবস্থার আয়ু আরো দীর্ঘ হয়েছে এবং তা যেকোনো সময়ের চেয়ে সবচেয়ে থিতু অবস্থায়। কিন্তু সৌদি আরবের সেই সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লব আবার এক অনিশ্চয়তা হিসেবে ছায়া ফেলেছিল। ইরানের বিপ্লব রাজতান্ত্রিক শাসনের ধর্মীয় ও নৈতিক ভিত্তিকে প্রশ্ন তুলে নড়বড়ে করে দেয়ার সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছিল। আরেক দিক থেকে দেখলে ইরানের এই বিপ্লবে ক্ষতিগ্রস্ত আমেরিকাও। কারণ সে শাহের ইরান হারিয়েছিল এবং নতুন বিপ্লবের ইরানের সাথে আমেরিকার আবার সহসাই কোনো ধরনের সম্পর্ক তৈরি হওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে গিয়েছিল। ইরান-সৌদি কূটনৈতিক সম্পর্ক সেই থেকে খারাপ থেকে আরো খারাপ হয়ে যায়। উল্টা দিকে আমেরিকার সঙ্গে ইরানের প্রায় স্থায়ী হয়ে যাওয়া খারাপ সম্পর্ক সৌদি আরবকে স্বস্তি দিয়েছিল। সৌদিরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, ইরান-আমেরিকার সম্পর্ক সঙ্ঘাতময়ই এবং এই সঙ্ঘাতের দীর্ঘস্থায়িত্বের মধ্যেই সৌদি আরব রাজতন্ত্রের ভাগ্য নিহিত। পরের ৩৫ বছর ধরে ইরান-আমেরিকার সম্পর্ক সঙ্ঘাতময় থেকেছে। তদুপরি, ইরানের ওপর আরোপিত পশ্চিমের অর্থনৈতিক অবরোধ ইরানকে যথেষ্ট ভুগিয়েছে। 
সবশেষে ২০১৫ সালে আমেরিকার ওবামা প্রশাসনের আমলে এক ‘নিউক্লিয়ার ডিল’-এর বিনিময়ে, ইরানের ওপর থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ ধাপে ধাপে তুলে নেয়া শুরু হয়েছিল। আর সেই থেকে সৌদি আরবের অস্বস্তি আর অস্থিরতা শুরু হয়ে যায়। রাজপরিবার সৌদি আরবে রাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম চিন্তিত হয়ে পড়ে।
ওবামা প্রশাসন ইরানের সাথে ‘নিউক্লিয়ার ডিল’ কেন করতে গিয়েছিল এর প্রধান কারণ ছিল আইএস মোকাবেলায় ইরানকে পাশে পাওয়া এবং অনেক দায় ও খরচ ইরানের ওপর দেয়ার সুযোগ নেয়া। কারণ ইরাকের ওপর আইএসের আক্রমণ ও তৎপরতার চাপ বাড়ছিল। ওবামা প্রথম টার্মে তো বটেই, দ্বিতীয় টার্মেও সামগ্রিকভাবে ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে ‘আমেরিকান সৈন্য প্রত্যাহার’ আর বিশেষ করে ‘মাঠের সৈন্য প্রত্যাহার’ এই নীতিতে পরিচালিত হচ্ছিলেন। এর মূল কারণ ছিল, আমেরিকান অর্থনীতির যুদ্ধের খরচ হলে অপারগতা। দ্বিতীয় কারণ এটাও ছিল যে, জড়িয়ে যাওয়া অন্তহীন যুদ্ধে থেকে দেশকে বের করে আনা। অথচ আইএসের তৎপরতা সেখানে মাঠের সৈন্য বাড়াবার তাগিদ হাজির করছিল। এই অপারগ পরিস্থিতিতে ‘সন্ত্রাসবাদ বিরোধী’ জোট তৎপরতায় ওবামা ইরানকেও অন্তর্ভুক্ত করে পেতে চাইলেন। বিশেষ করে আমেরিকার ইরাক দখলের পরের ইরাক ইরান প্রভাবিত মালেকী সরকারের হাতেই চলছিল। ফলে ওবামার হিসাব হলো, ইরাক সরকারের সাথে ইরান এসে যোগ দিয়ে তারাই ইরাকে আইএস তৎপরতা রোধের বাড়তি দায়িত্বে নিক। তাতে খরচের ও সামরিক দায়ের এক বড় অংশ ইরান সরকারই বহন করবে।
আর ওবামার এই নতুন নীতিকে সৌদি সরকার ঘোরতরভাবে নিজ স্বার্থবিরোধী এবং বিশেষ করে নিজ রাজতন্ত্রের জন্য বড় বিপদ হিসেবে দেখেছিল। তা থেকে আমেরিকার ওপর সৌদি ক্ষোভ আর হতাশা কত তীব্র হয়েছিল তা বুঝার একটা উপায় হলো সৌদি আরব রাশিয়ার পুতিনের সাথে নিজের সুরক্ষা নিয়ে কথা বলেছিল। আমেরিকার বদলে নিজের সুরক্ষার কাজ রাশিয়ার সাথে করা যায় কিনা, রাশিয়াকে দেয়া যায় কিনা সে আলোচনায় বসেছিল। তখন রাশিয়া থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থের অস্ত্র সৌদি আরব ক্রয়ের প্রস্তাব রাখা হয়েছিল। কিন্তু শর্ত ছিল, সিরিয়াসহ পুরা ইরানি ব্লক থেকে রাশিয়াকে দূরে সরে আসতে হবে। কিন্তু রাশিয়ার কাছে স্থায়ী ও কৌশলগত সম্পর্কের দিক থেকে ইরান-সিরিয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে। ফলে সেই প্রস্তাবিত রাশিয়া ডিল কোনো ইতি পরিণতি পায়নি। ইতোমধ্যে আমেরিকার নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রার্থিতার মধ্যে আশার আলো দেখেছিল সৌদি আরব। কারণ, যেটা বুঝা গিয়েছিল, ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট ফিরে এলে ইরান নিউক্লিয়ার ডিল উল্টে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। রিপাবলিকান হলে কিছু হলেও সম্ভাবনা আছে, যদি সবটা নেই। কারণ এটা শুধু ইরান-আমেরিকান সমঝোতা নয় বরং এটা জার্মানিসহ জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের (৫+১) সাথে একযোগে ইরানের ডিল।
এক কথায় বললে, ট্রাম্পের এই সৌদি সফর ছিল এক পুরোপুরি আই ওয়াশ। দেখানো হয়েছে, সৌদি উদ্যোগে পাকিস্তানের সাবেক সেনাপ্রধান রাহিলের নেতৃত্বে এক ‘আরব ন্যাটো’ গঠন করা হয়েছে। তা অপ্রকাশ্যে ইরানবিরোধী সুন্নি রাষ্ট্র জোট। ওই সুন্নিপ্রধান রাষ্ট্রগুলোর জনগণ না হোক অন্তত সরকারগুলোকে রাজতন্ত্রের পক্ষে বুক করে রাখা হলো। কিন্তু তামাশার দিকটা হলো এই ‘আরব ন্যাটো’ এটা করা হলো ‘সন্ত্রাসবাদবিরোধী ইসলামি রাষ্ট্রজোট’ বলে। আর এই জোটের উদ্বোধন আমেরিকান প্রেসিডেন্টকে দিয়ে করিয়ে তার মুখ দিয়ে ইরানবিরোধী বুলি হাজির করা হলো। 
তাই এমন কোনো মিডিয়া দেখা যায়নি, আমেরিকান বা বাইরের, যে এই সফরকে ইতিবাচকভাবে দেখেছে অথবা ফেসভ্যালুতেই সম্মেলন যা বলেছে তা বিশ্বাস করে। এর মূল কারণ, ট্রাম্প যতই হম্বিতম্বি করুন, আসলে তো ওবামার ‘ইরান নিউক্লিয়ার ডিল’ থেকে ট্রাম্প একচুলও সরেননি।
মিডলইস্টের মনিটর পত্রিকা জানাচ্ছে, স্টেট ডিপার্টমেন্টের টিলারসন বলেছেন ‘১৮ এপ্রিল কংগ্রেসকে চিঠি দিয়ে তিনি সার্টিফাই করে জানিয়েছেন, ইরানি ডিলে ইরান সঠিকভাবে তার করণীয় শর্তাবলি মেনে চলছে’। আরেক কর্মকর্তা বলছেন, তারা যদিও এখনো পর্যন্ত ইরানি ডিল পুরোটাই পর্যালোচনা করে দেখছে। কিন্তু ওইদিন পর্যন্ত সবকিছুই ইরান ঠিকঠাক পালন করেছে ফলে তারা চুক্তি বজায় রাখার পক্ষে থাকবে। 
তাহলে পাগলা ট্রাম্প উল্টা হাওয়া গেছে সৌদি আরবে গেল কেন? কারণ ১১০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি হলে ক্রেতার সন্তুষ্টিতে কিছু তো করা দরকার!
লেখক :  গৌতম দাস, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

শুক্রবার, ২৬ মে, ২০১৭

মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র নিয়ে দাবা খেলা

গত মাসে সিরিয়ার যুদ্ধ ছয় বছরে পদার্পণ করেছে। ২০১১ সালের ১৫ মার্চ এই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ ক্রমে জটিল আকার ধারণ করে এক প্রলম্বিত যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছে। সিরীয় যুদ্ধে বাইরের বহু খেলোয়াড় এবং ভাড়াটে সৈন্য প্রবেশ করার কারণে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এই যুদ্ধক্ষেত্রে ২০১২ সালে ইরানি সৈন্য এবং হিজবুল্লাহর অনুপ্রবেশ ঘটে। এরপর ২০১৪ সালে কথিত ইসলামিক স্টেট, পরবর্তীকালে ২০১৫ সালের শেষের দিকে রাশিয়া এবং অতিসম্প্রতি আমেরিকার স্থলসৈন্য প্রবেশ করেছে। আমেরিকার স্থলসৈন্যরা তাদের সামরিক যান নিয়ে ২০১৭ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে ক্রমবর্ধমানভাবে সিরিয়া-ইরাক সীমান্ত অতিক্রম করে সিরিয়ায় প্রবেশ করায় এই যুদ্ধ সম্পূর্ণ নতুন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে।
২০১১ সালের মার্চে সিরিয়ার যুদ্ধ যখন শুরু হয়েছিল তখন তা ছিল সিরীয় সরকার ও তার বিরোধীদের মধ্যকার নিছক একটি ক্ষমতার লড়াই। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দৃশ্যপট সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। সিরিয়ার দৃশ্যপটে এখন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়রা মধ্যপ্রাচ্যের একটি নতুন মানচিত্র প্রণয়নের লক্ষ্যে দাবার ঘুঁটি হিসেবে বিশাল দাবা প্রতিযোগিতায় নিয়োজিত। যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা হচ্ছে কনভেনশনাল। ২০০ মেরিন এবং ৭৫তম রেজিমেন্ট আর্মি রেঞ্জারস। আগে কাবুল, বাগদাদ এবং মসুলে হিট অ্যান্ড রান স্পেশাল অপারেশনের জন্য একটি এলিট ফোর্স ব্যবহার করা হয়েছে। 
মার্কিন সৈন্যদেরকে সাময়িকভাবে ইউফ্রেটিস নদীর ৩০ কিলোমিটার পশ্চিমে কৌশলগত শহর মানবিজে মোতায়েন করা হয়েছে। তারা বহুমুখী এজেন্ডা নিয়ে এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) স্বঘোষিত রাজধানী আল রাক্কা শহরে একটি বড় ধরনের হামলা পরিচালনা করা এবং মানবিজ শহরকে আইএস আর তুর্কিদের থেকে মুক্ত করার বিষয় নিশ্চিত করা এবং যুদ্ধক্ষেত্রে সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস (এসডিএফ) নামে পরিচিত মার্কিন সমর্থিত মিলিশিয়াদের বিরোধিতা না করা।
দুই বছর আগে বারাক ওবামার অধীনে গঠিত এসডিএফের যোদ্ধারা এখনো আমেরিকান পে-রোলে পরিচালিত হচ্ছে। তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলভিত্তিক সিআইএ কর্মকর্তারা বিভিন্ন বিদ্রোহী গ্রুপকে তীব্র হুমকি দেয়া সত্ত্বেও তারা অর্থাৎ এসডিএফ যোদ্ধারা আমেরিকান পে-রোলে রয়েছে। বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর প্রতি মাসের শেষে একটি সামরিক কমান্ডের অধীনে ঐক্যবদ্ধ না হলে মার্কিন সহায়তা বন্ধ করে দেয়া এবং তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে স্থান ত্যাগ করে চলে যাওয়ার আহ্বান জানানো হবে বলে হুমকি দেয়া হয়েছে। বিদ্রোহী গ্রুপগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করা এখন খুব কঠিন কাজ। কারণ বিদ্রোহীদের মধ্যে একপক্ষকে ‘উদারপন্থী’ এবং অপরপক্ষকে সিরিয়ার আলকায়েদার শাখা জাবহাত আল নুসরা হিসেবে আগে পরিচিত, এখন জাবহাত ফাতাহ আল শাম-এর সাথে সংশ্লিষ্ট বলে চিহ্নিত করে বিভাজন সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করা খুব কঠিন। কয়েক বছর ধরে আমেরিকা সিরিয়ার বিদ্রোহীদেরকে জাবহাত আল ফাতাহ আল শাম থেকে দূরে রাখার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। এটা হচ্ছে অত্যন্ত কার্যকর অল সিরিয়ান ফাইটিং ফোর্স। তারা সিরিয়ার সরকারি বাহিনীকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তাই বিদ্রোহীদেরকে জাবহাত ফাতাহ থেকে দূরে সরানো বাস্তবে অসম্ভব। অপর দিকে আইএস বিদেশী যোদ্ধাদের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কালো তালিকাভুক্ত হয়ে গেছে। এই চূড়ান্ত শর্ত বা প্রস্তাবের একমাত্র ব্যতিক্রম হলো এসডিএফ।
এসডিএফের সৈন্যরা গত আগস্ট মাসে মানবিজে গুড় গুড় করে মাঝে মধ্যে ঝাঁকানি দিতো। তারা শহরটিকে সম্পূর্ণরূপে আইএসমুক্ত করে কেবল শহরটিকে গত মার্চ মাসে সরকারি সৈন্যদের কাছে হস্তান্তর শুরু করেছে। কুর্দি কমান্ড এবং রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর মধ্যে যে চুক্তি হয়েছেÑ তাকে ধন্যবাদ জানাই। 
বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার 
সাম্প্রতিক সামরিক অগ্রগতির অর্থ সিরীয় যুদ্ধে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের কাছে বিভিন্ন বিষয় বোঝায়। তারা ভিন্ন ভিন্নভাবে এটাকে উপলব্ধি করে। সিরিয়া সরকারের জন্য এতে বলা হয়, সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে রাশিয়ান ও আমেরিকানদের কাছ থেকে সিরীয় সরকার যৌথভাবে অনুমোদন পেতে শুরু করেছে। মানবিজ বাহিনী বা সৈন্যদের ক্ষতি হলো- প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে তার বাফার জোনের ধারণাকে ছোট করতে হয়েছে। এরদোগান এবং পুতিন গত গ্রীষ্মে একটি বাফার জোন প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছিলেন। এখন মনে হচ্ছে, কেবল সীমান্ত শহর জারাব্লুস ও আজাজকে এবং আল বারের একটি মধ্যাঞ্চল অন্তর্ভুক্ত করে একটি বাফার স্টেট গড়ে তোলা যাবে। এই এলাকাগুলোর সবই বর্তমানে তুরস্কের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
এরদোগান সেখানে থামবেন না। মানবিজের দিকে অগ্রসর হয়ে এবং আল রাক্কাকে একীভূত করার মাধ্যমে এরদোগান যুগপৎভাবে রাশিয়ান ও আমেরিকান উভয়কে ক্ষুব্ধ করে তুলেছেন। উভয় দেশ আইএস থেকে মুক্ত করে আল রাক্কাকে স্বাধীনতা দিতে চায় না। তারা এরদোগানের নিয়ন্ত্রণেও রাক্কাকে দিতে চায় না। এরদোগান পাঁচ হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তনের একটি জোন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সচেতন ও বেপরোয়া। তার সীমান্তে কুর্দিদের একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উচ্চাভিলাষকে গুঁড়িয়ে দিয়ে ২০ লাখেরও বেশি সিরীয় শরণার্থীর তত্ত্বাবধান ও আশ্রয়দানের লক্ষ্যে একটি পরিচ্ছন্ন ভূমি দিতে চান এরদোগান। উল্লেখ্য, ২০১১ সাল থেকে এসব সিরীয় শরণার্থী তুরস্কে অবস্থান করছেন।
ওই ফর্মুলা আলোর মুখ দেখলে, ইরান সিরিয়ায় দামেস্ক-বৈরুত মহাসড়ক নামক ‘পকেট’ ছাড়া আর বেশি কিছু পাবে না। দামেস্কে শিয়াদের পবিত্র স্থান বরাবর চলে যাওয়া এই মহাসড়কটি হচ্ছে হিজবুল্লাহর গুরুত্বপূর্ণ লাইফলাইন, দামেস্কের পশ্চিমের কালামুন জেলার সাথেও মহাসড়কটির সংযুক্তি রয়েছে। কালামুন জেলাটি লেবানন সংলগ্ন। পাঁচ বছর ধরে সড়কটির ওপর হিজবুল্লাহর সুদৃঢ় নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। 
সিরিয়ান কেক বা খাদ্যে এটাই হলো তাদের ভাগের সীমা। তারা এর চেয়ে বেশি ভূখণ্ডে কামড় বসাতে পারবে না। কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়ারা লেবানন ও ইরাকে যেভাবে অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধ করে জীবন দিতে চায়- সিরিয়ায় তারা সেভাবে মরতে চায় না। 
তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, আমেরিকা মানবিজে এসডিএফকে অব্যাহতভাবে সমর্থন জানাতে থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের সম্পর্ক ‘মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত’ হবে। যুদ্ধক্ষেত্রে তুরস্ক হচ্ছে আমেরিকার অত্যন্ত নির্ভরশীল ও বিশ্বাসযোগ্য অংশীদার। এ পর্যন্ত এই সম্পর্ক নষ্ট করার কোনো ইচ্ছা যুক্তরাষ্ট্রের নেই। গত ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্প প্রশাসন তাদের কিছু সামরিক প্রয়োজন পূরণ করেছে এবং আল রাক্কাকে মুক্ত করতে আমেরিকা তুরস্কের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করবে। তুরস্ক রাক্কায় কখনো কুর্দিদের শাসন করতে দেবে না। ট্রাম্প প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, সিরিয়ায় নতুন প্রেসিডেন্টের তিনটি অগ্রাধিকার রয়েছে। সেগুলো হলো : ইউফ্রেটিসের পূর্বে কুর্দিদের ক্ষমতায়ন। ট্রাম্প প্রশাসন আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এবং তাদের নির্মূল করতে কুর্দিদের গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছে। এই প্রশাসনের অগ্রাধিকারে আরো রয়েছেÑ সিরিয়া থেকে ইরান ও হিজবুল্লাহকে বের করে দেয়া। ২০১২ সাল থেকে তাদের অর্থাৎ ইরান ও হিজবুল্লাহর ওপর সিরিয়া সরকারের আস্থার কারণে এই কথা বলা সহজ হলেও করা কঠিন।
‘ইউফ্রেটিসের পূর্বে’ এই কথার মাধ্যমে সাধারণভাবে সিরিয়ার কুর্দি অঞ্চলকে উল্লেখ করা হলেও একসময় যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ় সমর্থনের কারণে সেখানে গোলাগুলি বন্ধ হয়ে যায়। আবার মার্কিন সমর্থন বাদ দিয়ে পরে প্রধানত, ‘ইউফ্রেটিসের পশ্চিমে’ এবং সিরিয়ার অন্যান্য প্রধান শহর হোম, হামা, আলেপ্পো ও দামেস্কে রাশিয়া নিজের প্রভাব বিস্তার করে বসে।
ইউফ্রেটিসের পূর্বে সব ভূখণ্ড কুর্দিদের নিয়ন্ত্রণে নেই। বিশেষভাবে আল রাক্কা- যেটা ইউফ্রেটিসের পূর্বাঞ্চলীয় তীরে অবস্থিত অথবা অপর শহর তেলসমৃদ্ধ দেইর ইজ জোর যেটাকে ট্রাম্প দ্রুত আইএসমুক্ত করতে চান- সেটি কুর্দিদের নিয়ন্ত্রণে নেই। আল মালিকিহ, আল হাসাকিহ এবং আল কামিশির মতো শহরের মধ্যেই কুর্দি অঞ্চল সীমাবদ্ধ।
দাবা খেলার ছক কাটা ফলের সশস্ত্র বিরোধিতা করা কিভাবে শোভন বা মানানসই হয় সে ব্যাপারে মন্তব্য করতে বললে তাহরির ইনস্টিটিউট ফর মিডলইস্ট পলিসির সিনিয়র ফেলো হাসান হাসান গালফ নিউজকে বলেন, আক্ষরিকভাবে বিদ্রোহীরা অত্যন্ত টাইট স্পটে রয়েছে। গত অর্ধবছরে তুরস্কের অগ্রাধিকার পরিবর্তন হয়ে গেছে। সিরিয়া রাশিয়ার সাথে সমঝোতার ফলে কাতারের হাত বাঁধা রয়েছে। কাতারিরা আগে যেভাবে সমর্থন দিয়েছিল সেভাবে আর সমর্থন দিতে পারবে না। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ক্রমবর্ধমানভাবে খেলার আইনকানুনের দিকে দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে। এর আরো অর্থ হচ্ছে, তুরস্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোকে মস্কোর সাথে চুক্তি করতে হবে। দামেস্ক আইএস এবং আলকায়েদার উত্থান থেকে ফায়দা হাসিল করার ফন্দি আঁটে।
পেন্টাগনের কর্মকর্তারা আসন্ন যুদ্ধের যাবতীয় বিষয় পরিচালনায় যখন ব্যস্ত তখন এমনকি পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনসহ পররাষ্ট্র দফতর একেবারেই নীরব। অবশ্য রেক্স টিলারসন গত সপ্তাহে জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতায় জেনেভায় অনুষ্ঠিত শান্তি আলোচনায় নেতৃত্ব দেন। ২০১৪ সালের পর এই প্রথম এ ধরনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো।
রেক্স টিলারসনের পূর্বসূরি জন কেরি আগ বাড়িয়ে বিষয়টি জানালেও গত এপ্রিলে সেই উদ্যোগ থেমে যায়। মস্কো অথবা তেহরান কেউই প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী না হওয়ায় বিষয়টি অমীমাংসিত থাকে। কিন্তু সৌদি আরব, ফ্রান্স ও আমেরিকা এখন পর্যন্ত বিষয়টি মীমাংসা করার জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছে। 
বৈশিষ্ট্যহীন নীরবতা
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট এবং দেশটির রাজনৈতিক পরিবর্তনের ব্যাপারে টিলারসন এবং তার সরকারের অবস্থান সম্পর্কে তিনি একেবারেই নীরব। এ ব্যাপারে ট্রাম্প এবং হোয়াইট হাউজও নীরব। মস্কোয় তেহরান এবং দামেস্ক এটাকে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিগ্রাহ্য পশ্চাৎপসারণ এবং ‘সিরিয়া ফাইলের’ আউট সোর্সিং হিসেবে দেখছে। যুক্তরাষ্ট্র অন্ততপক্ষে এটাকে পুতিনের কাছে তাদের রাজনৈতিক উপাদান হিসেবে দেখছে।
রুশরা এখনো আলোচনার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তারা চলতি মাসে সুইজারল্যান্ডে দুই দফা আলোচনায় মিলিত হয়। এই আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নি¤œপর্যায়ের একজন কর্মকর্তা এবং ডেপুটি রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী গেন্নাদি গাতিলোভ উপস্থিত ছিলেন। তারা দ্রুত রাজনৈতিক ক্রান্তিকাল প্রক্রিয়া শেষ করার ওপর জোর দেন। তারা সরকারি শাসন থেকে বিরোধীদলীয় শাসন নয়Ñ বরং ক্ষমতা ভাগাভাগির ফর্মুলার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এই ফর্মুলায় একটি নতুন সংবিধান, নতুন পার্লামেন্ট, নতুন করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আয়োজন করা- যাতে বাশার আল আসাদ আরো দুই মেয়াদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন- ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হয়।
সম্প্রতি নতুন করে প্রণীত সংবিধানে রাশিয়া প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা হ্রাস করার এবং বাশারকে আগামী নির্বাচনসহ দুই মেয়াদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ দেয়ার পরামর্শ দেয়। উল্লেখ্য, ২০২১ সালে পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। তারা মস্কো সমর্থিত সিরীয় বিরোধী দলকে ৩০ সদস্যের মন্ত্রিসভায় ১০টি মন্ত্রণালয় দিতে সম্মত হয়েছে। কিন্তু তারা সৌদি অর্থ সহায়তায় গঠিত উচ্চপর্যায়ের আলোচক কমিটি (এইচএনসি) সাথে ব্যবসাবাণিজ্য নিয়ে এবং বেসামরিক রাজনীতিকদের সাথে কথা বলেনি। সব পক্ষ ২৩ মার্চ প্রস্তাবিত শর্তাবলি নিয়ে আলোচনার টেবিলে ফিরে যাওয়ার কথা। তারা বছরের অবশিষ্ট সময়ে এই প্রক্রিয়ার সমাপ্তি ঘটবে বলে আশাবাদ ব্যক্তি করেছেন। তারা ২০১৭ সাল শেষ হওয়ার আগে আলোর মুখ দেখতে পাবেন বলে আশা করছেন। 
লেখক :  
সামি মোবাইদ সিরীয় ইতিহাসবিদ। আন্ডার দ্য ব্ল্যাক ফ্ল্যাগ : অ্যাট দ্য ফ্রন্টিয়ার অব দি নিউ জিহাদ গ্রন্থের লেখক। 
গালফ নিউজ থেকে ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার