বৃহস্পতিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১১

যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে আন্দোলন : কারণ খুবই স্পষ্ট


যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে আন্দোলন

ওয়ালস্ট্রিটবিরোধী আন্দোলনকারীদের খবর মিডিয়া সারা জাতির সামনে কিভাবে উপস্থাপন করছে তা আমার জানার দরকার নেই। তারা পুরো ব্যাপারটি ঘিরে এখনো অস্পষ্টতা রয়েছে বলে দাবি করেছে। সেটি নিয়েও আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। তবে আমি কিন্তু এই আন্দোলনকারীদের কণ্ঠ থেকে সুস্পষ্ট একটি বক্তব্য শুনতে পেয়েছি। আমি তাদের পক্ষ হয়ে কথা বলছি না। তবে আমার যাপিত জীবন আর তাদের যাপিত জীবন কিন্তু একই। চেতনাগত দিক থেকেও আমাদের অবস্থান অভিন্ন এবং আমার সঙ্গে সহমত পোষণকারীর সংখ্যাও কিন্তু লাখ লাখ। আমরা সবাই বলছি, যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়। এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষ সবসময়ই কঠোর পরিশ্রম করেছে সৎ উপায়ে বেঁচে থাকার মতো একটু আয়-উপার্জনের জন্য। তারা চেয়েছে ন্যায্য কিছু সুযোগ-সুবিধা, চেয়েছে অমানুষিক পরিশ্রমের পর প্রয়োজনীয় একটু বিশ্রাম, বছরান্তে কিছু ছুটিছাটা আর অসুস্থ হয়ে পড়লে বাড়িতে থাকার অধিকার। কিন্তু সেই আশির দশক থেকেই শ্রমজীবী মানুষ লাগাতার বৈষম্য আর অধিকারহীনতার শিকার হয়ে আসছে। তারা কাজ করেছে বেশি কিন্তু মজুরি পেয়েছে কম। তারপরও তাদের যা পেয়েছে তাই নিয়ে আনন্দে থাকতে বলা হয়েছে। কৃতজ্ঞ থাকতে বলা হয়েছে। যথেষ্ট হয়েছে আর নয়।
শ্রমজীবী তরুণ প্রজন্মের কলেজপড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের অধিকার ছিল নিজেদের পছন্দ মতো ভবিষ্যৎ বেছে নেয়ার, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর কোন পেশা তারা গ্রহণ করবে আর কোনটা করবে না সে অধিকারও এক সময় ছিল তাদের। অথচ এখন তাদের পড়াশোনার খরচ চালাতে গিয়ে ঋণের জালে আটকে যেতে হচ্ছে; কর্মজীবনের শুরুতেই হন্যে হয়ে ঘুরতে হচ্ছে একটি চাকরির জন্য। হাজার হাজার, লাখ লাখ কর্মক্ষম মানুষ এখন বেকার। যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়।
অথচ ইতোমধ্যেই করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের বেতন বেড়েছে বহুগুণ। করপোরেট মুনাফার পরিমাণ আকাশ ছুঁয়েছে। যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়।
ওয়াশিংটন ডিসি থেকে শুরু করে আলাদা আলাদাভাবে প্রতি রাজ্যে সব দলের রাজনীতিকরাই ধনীদের তোয়াজ করছেন, তাদের কাছ থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ নিচ্ছেন এবং ওয়াদা করছেন, তারা সেই অর্থ প্রদানকারীদের স্বার্থ দেখবেন। অন্যদিকে শ্রমজীবী ভোটারদেরও মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বলছেন, তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, আবাসন, সুপেয় পানি, জননিরাপত্তা এবং দারিদ্রে্যর মতো বিষয়গুলোর ব্যাপারে তারা মনোযোগী হবেন। কিন্তু নির্বাচনের পর তারা এই শ্রমজীবীদের কথা একেবারেই ভুলে যান; ব্যস্ত হয়ে পড়েন কেবল তাদের পেছনে বড় বড় অংকের অর্থ লগ্নিকারীদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়গুলো নিয়ে। যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়।
আপনারা শ্রমজীবী মানুষের সন্তানদের যুদ্ধে পাঠাচ্ছেন। কখনো কখনো দেখা গেছে তাদের যুদ্ধে পাঠানোর পেছনে আপনাদের ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থই কেবল জড়িত। আপনারা আপনাদের বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিটি তাদের গেলাতে চান। আর সেটা করতে গিয়ে তাদের পরিবারগুলো ছন্নছাড়া হয়ে যাচ্ছে, নেমে আসছে পারিবারিক বিপর্যয়। আপনারা তাদের মজুরি দিচ্ছেন সামান্যই এবং সুযোগ-সুবিধাগুলোও কাটছাঁট করে ফেলছেন ইচ্ছেমত। আসলে আপনারা মানুষের মর্যাদা এবং দেশের কথা মোটেই ভাবেন না। আপনারা মুখে মুখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ভালোবাসার কথা বলেন, সৈনিকদের কানে ভালোবাসার কথা শোনান। কিন্তু আপনাদের প্রকৃত ভালোবাসার নজর অন্যদিকে। সত্যি কথা বলতে কি, আপনারা আসলে ভালোবাসেন মুনাফা, ক্ষমতা এবং হরেক রকমের সুযোগ-সুবিধা। আর এগুলো পাওয়ার জন্যই আপনারা আপনাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়। ইতোমধ্যে ব্যাংকার এবং ওয়ালস্ট্রিটের ব্যবসায়ীরা ক্রয়-বিক্রয় যোগ্য সব কিছুই বেচে-কিনে শেষ করে দিয়েছে। ধনীরা আরো ধনী হয়েছে, তাদের চাকচিক্য আর খোলতাই বেড়েছে। ওয়ালস্ট্রিটের স্বার্থ রক্ষাকে কেন্দ্র করে ক্ষমতা ঘুরপাক খাচ্ছে। রিয়েল এস্টেট খাতের ঋণ ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল। শেষে ফুটু বেলুনের মতো চুপসে গেছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছে, করপোরেশনগুলো জনগণে রূপান্তরিত হয়েছে। মুনাফা তার নিজের স্বার্থে জনগণকে পশুখাদ্যে পরিণত করেছে। এটিই ওয়ালস্ট্রিটের কাজ। প্রতিটি রাজনীতিক এখন ক্ষমতার জন্য পাগল। তারা দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায়। সারা বিশ্বকেও চায় তাবে রাখতে। যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়।
ওয়ালস্ট্রিট দখলকারীদের দাবিগুলো কী? মিডিয়াতে অনেকেই এই প্রশ্ন রেখেছেন। কিন্তু মিডিয়া এ ব্যাপারে অস্পষ্টতার দোহাই দিচ্ছে। আসলে তাদের দাবি খুবই পরিষ্কার। তারা চায় এই জাতির যেকোনো ধরনের মানবীয় উদ্যোগ আর যেন ওয়ালস্ট্রিট এবং সরকারে তাদের অনুগতদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে না পারে। যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়।
কয়েক বছর আগেই গর্ডন জিকো ওয়ালস্ট্রিটের লোকজনের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘লালসা খুবই ভালো।’ বাক্যটি একটি সিনেমা থেকে নেওয়া হলেও এটি ধ্রুপদী মর্যাদা পেয়ে গিয়েছিল। মুনাফার পেছনে ছুটতে থাকা একটি প্রজন্মের কাছে এটি একটি প্রার্থনা বাক্যে পরিণত হয়েছিল। যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়।
কিন্তু এখন যারা ওয়ালস্ট্রিট দখল করে আছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে যারা তাদের সমর্থন জানাচ্ছে তারা সবাই এখন সমস্বরে বলছে, লালসা মোটেই ভালো নয়। লালসা আমাদের ঘর চুরি করে, আমাদের স্বাস্থ্য চুরি করে, আমাদের ভবিষ্যৎ স্বপ্ন চুরি করে। লালসা আমাদের পড়াশোনার সময়গুলো ছিনিয়ে নেয়, জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার সময়গুলোও সে চুরি করে নিয়ে যায়। চুরি করে নেয় আমাদের বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সুযোগ, সন্তানের বাবা-মা হওয়ার সম্ভাবনা। লালসা আমাদেরকে সম্মানের সঙ্গে অবসরে যাওয়া থেকেও বঞ্চিত করে। লালসা ভালো নয়। সুতরাং লোভ-লালসাকে উজ্জীবিত করার মতো নীতি এবং সেগুলোর প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে। হতে পারে সেটি শক্তি প্রয়োগ কিংবা সম্ভাব্য অন্য যেকোনো উপায়ে। আপনি তো জানেনই, কোন ধরনের নীতি আপনার এক শতাংশ বন্ধুর মধ্যে লালসা জাগায় আর কোন ধরনের নীতি আপনার ৯৯ শতাংশ বন্ধুর জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়।
আমরা তো আপনাদের বহুবার বলেছি, আমরা একটি সমতাভিত্তিক সুন্দর জীবন চাই। আমরা তো বিনা পয়সায় কিছু চাচ্ছি না। খেটে খাওয়া, শ্রমজীবী মানুষ কোনদিনই এমনটা চায়নি। তবে ওয়ালস্ট্রিটের লোকজন চেয়েছে। আপনারা আমাদের যা দিয়েছেন তা নিয়েই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। কিন্তু আপনারা যখন আমাদের কথাটা শুনতে পর্যন্ত অনীহ হয়ে পড়েছেন তখনই রাস্তায় নেমে আসতে বাধ্য হয়েছি আমরা। আপনারা এই শ্রমজীবী মানুষের বিশ্রামের সুযোগটি পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছেন। যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়। আপনারা আমাদের একটু করে রুটি ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, এটি নিয়েই সন্তুষ্ট থাক। আমরা থেকেছি। কিন্তু সেই রুটিটিও যে এখন কেড়ে নিচ্ছেন। আপনারা সব নীতিই প্রণয়ন করছেন আপনাদের এবং ওয়ালস্ট্রিটে অবস্থানকারী আপনাদের সহযোগীদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে। আপনাদের কর্মকান্ড আবারো একটি অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। আপনারা আমাদের বলছেন, তোমাদের তো একটি চাকরি আছে, তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাক, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। আর তুমি যদি সেটি না করতে চাও তবে আরো অনেকেই আছে যারা সেটি করতে চায়। এই মন্ত্রই কি আপনারা আমাদের গেলাচ্ছেন না? আপনারা একজন শ্রমিকের বিরুদ্ধে আরেকজন শ্রমিককে উস্কে দিচ্ছেন, প্রতিবেশীকে ক্ষেপিয়ে তুলছেন প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে। যথেষ্ট হয়েছে আর নয়।
আপনার কাছ থেকে পাওয়া রুটিটিই কিন্তু যথেষ্ট নয়। শ্রমজীবী মানুষের বাড়তি আয় কিন্তু দিন দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে। সঞ্চয় বলে তাদের কিন্তু কিছুই আর এখন নেই, দুর্দিনে যার ওপর নির্ভর করা যায়। ওয়ালস্ট্রিটসহ অন্যান্য মাধ্যম দিয়ে আমাদের সব সম্পদ পাচার হয়ে এখন আপনাদের পকেটে গিয়ে ঢুকছে। আমরা আপনাদের মতো হতে চাই না। আমরা পুরোপুরিভাবেই মানবিক হতে চাই। আমরা মুক্ত থাকতে চাই আপনাদের লোভী নিয়ন্ত্রণ থেকে। যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়। আপনাদের ঐশ্বর্যের যারা প্রশংসা করে তাদের মতো বিস্ফারিত নেত্রে আমরা আপনাদের দিকে তাকাতে চাই না। আপনারা মানুষের ওপর নিষ্পেষণ চালান। আপনাদের পদ ও সম্পদ অর্জনের পথে যারাই বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাদেরই আপনারা পদদলিত করেন। মানবীয় জীবন সম্পর্কে আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে আমরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি। আপনাদের তাকানো দেখেই আমরা সেটা অাঁচ করতে পারি। যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়।
আমাদের কি দাবি তা জানতে চান? আমাদেরকে আমাদের মানবীয় মর্যাদা ফিরিয়ে দিন। আমরা সুস্থ পরিবেশে জীবন ধারণ উপযোগী কর্ম এবং মজুরি পেতে চাই। আমরা সসম্মানে চাকরি থেকে অবসর নিয়ে ভালোবাসাসহ বাকি জীবনটা উপভোগ করতে চাই। স্বাস্থ্যসম্মত ঘরবাড়ি চাই যেখানে থাকবে বিশুদ্ধ বায়ু আর সুপেয় জল। থাকবে আমাদের শিশুদের জন্য ভালো ভালো স্কুল। অসুস্থ হয়ে পড়লে, আহত হয়ে পড়লে কিংবা নিঃস্ব হয়ে পড়লেও আমরা যেন সুচিকিৎসা পেতে পারি তার নিশ্চয়তা চাই। সংক্ষেপে বলতে গেলে, সভ্য জগতের মানুষ হিসেবে সসম্মানে বাঁচার জন্য যে সব উপকরণ এবং সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন সেগুলোই আমরা পেতে চাই। ধনীদের ওপর করারোপ অন্যায় কিছু নয়। কিন্তু ধনীদের সুখে রাখতে খেটে খাওয়া মানুষের ওপর উচ্চহারে করারোপ অবশ্যই অন্যায় ও অন্যায্য। যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়।
আপনাদের জন্যে যথেষ্ট কখনোই যথেষ্ট বলে বিবেচিত হবে না। তবে আমরা যারা অপরিচ্ছন্ন জনতা এবং আপনাদের মুনাফা ও সীমাহীন লালসার পশুখাদ্যে পরিণত হয়েছি তাদের কাছে যথেষ্ট শেষ পর্যন্ত যথেষ্ট হিসেবেই আদ্রিত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন